× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং চীনের প্রভাব

প্রথম পাতা

প্রফেসর আলী রীয়াজ
২৭ জানুয়ারি ২০২২, বৃহস্পতিবার

২০২১ সালে মসনদে দৃঢ়ভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল বাংলাদেশ। শাসক দল কোনো শক্তিশালী বিরোধিতার মুখোমুখি হয়নি। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০তম বছর উদ্‌যাপন করেছে এবং দেশে করোনা মহামারির যে পূর্বাভাস ছিল তার চেয়ে অনেক কম বিধ্বংসী রূপ দেখা গেছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্রেসি সামিট থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ দেয়া ছিল প্রথম ইঙ্গিত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে চলমান গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ লক্ষ্য করছে। এরপর মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর সাতজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশ প্রধানসহ দুই জন কর্মকর্তার ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। যদিও বাংলাদেশ সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং আমেরিকার ‘একতরফা’ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে।

২০২০ সালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে টানাপড়েন দেখা দিতে শুরু করে, কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভারত খুব একটা ভালো মনে নেয়নি। ২০২০ সালে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও ভারত যখন বাংলাদেশে কোভিড ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তখন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গিয়েছিল। যেহেতু বাংলাদেশ সেইসময়ে ভারতে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের উপর ভীষণভাবে নির্ভর করছিল, তাই সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্তের জেরে জনসাধারণের মধ্যে একটি গুরুতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল।
সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় চীন। এই পরিস্থিতি চীনকে তার ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’ ত্বরান্বিত করার সুযোগ এনে দিয়েছিল, যদিও বাংলাদেশ এর আগে একটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানোর জন্য চীনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল।
বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চীনের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি স্পষ্ট। চীন তার ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রদর্শন করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের কোনো সামরিক জোটে যোগদান করা উচিত নয় এবং দেশটিকে কোয়াডে যোগদানের বিরুদ্ধেও সতর্ক করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এটি প্রত্যাখ্যান করে, তবে চীনের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা হ্রাস করেনি। ১৯৭০ সাল থেকে চীন বাংলাদেশে হাল্কা অস্ত্রের প্রধান সরবরাহকারী দেশ এবং ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অস্ত্র সরবরাহের প্রায় ৭৫ শতাংশ এসেছে চীন থেকে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এখনো অব্যাহত রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার পর সরকার কিছু শরণার্থীকে প্রত্যন্ত দ্বীপে স্থানান্তর করতে শুরু করে যা শরণার্থীদের সহায়তা এবং সুরক্ষা প্রদান করবে। তারপর থেকেই শরণার্থী শিবিরে অপরাধের হার ও সহিংসতা বেড়েছে এবং অক্টোবরে একজন সুপরিচিত রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসংঘের একজন প্রতিবেদক বলেছেন যে, রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি শরণার্থীদের হত্যা ও সন্ত্রাসের পিছনে রয়েছে।

২০২১ জুড়ে, সরকারবিরোধী বিক্ষোভের বিক্ষিপ্ত বিস্ফোরণ ঘটেছে, মূলত: ক্ষমতাসীন দলের সরকার পরিচালনার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন বিরোধীরা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, লেখক এবং সমাজকর্মী মুশতাক আহমেদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অভিযুক্ত হয়ে জেলে মারা যাওয়ার পরে বিক্ষোভের আঁচ বাড়তে থাকে। তাকে নয় মাস জেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি যে কোনো ভিন্নমতকে ঠেকাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০২১ এর ১৯-২৯শে মার্চের মধ্যে, মোদিবিরোধী বিক্ষোভগুলো দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং সরকারের কঠোর পদক্ষেপের জন্য কমপক্ষে ১০ জন প্রাণ হারিয়েছিল। রক্ষণশীল ইসলামী দল হেফাজতে ইসলামের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। নভেম্বরের শেষের দিকে, সড়ক দুর্ঘটনায় একাধিক মৃত্যুর পর পরিবহন মালিক এবং সরকারের মধ্যে আঁতাতের অভিযোগ তুলে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবিতে সোচ্চার হন দেশের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন ২০১৮ সালের একটি আন্দোলনকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যা তৎকালীন সরকারকে একটি নতুন আইনের খসড়া তৈরি করতে বাধ্য করেছিল।

বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সময়, দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সমপ্রদায় সবচেয়ে খারাপ হামলার সাক্ষী থেকেছে। অন্তত ১৯টি জেলায় সম্পত্তি ও মন্দিরে হামলার খবর পাওয়া গেছে। অভিযোগ করা হয় যে, সব জেনেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চোখ বন্ধ করে রেখেছিল এবং স্থানীয় প্রশাসনও সহযোগীর ভূমিকায় ছিল।

রাজনৈতিক ফ্রন্টে, সরকারের বেপরোয়া নিপীড়ন এবং ঐক্যের অভাবের কারণে বিরোধীরা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) কেবল তার নেতৃত্ব নয়, তার ভবিষ্যৎ নিয়েও সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া- যিনি দুর্নীতির অভিযোগে ১৭ বছরের সাজা ভোগ করছেন- ২০২১ সালের নভেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হন। তার সাজা ২০২০ সালের মার্চ মাসে স্থগিত করা হয়েছিল এবং তাকে বাড়িতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে শুধুমাত্র এই শর্তে যে, তিনি রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবেন না এবং ভ্রমণ করতে পারবেন না। তাই খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার ও দলের অনুরোধ সরকার প্রত্যাখ্যান করে।

মহামারি সত্ত্বেও, পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি এবং রেমিটেন্স বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের জিডিপি ৬.৬ শতাংশ এবং আগামী বছর তা ৭.১ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান দাবি করে যে, দেশের মাথাপিছু আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে হয়েছে ২৫৫৪ মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উন্নীত করার প্রস্তাবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অনুমোদন দিয়েছে, যা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তবে ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল মানুষের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা উদ্বেগের বিষয়। আগস্টে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময়, ৩২ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছেন। জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়বৃদ্ধি, বিশেষ করে জ্বালানির দাম বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে মধ্যবিত্তরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কম টিকাদানের হার সত্ত্বেও বাংলাদেশ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় মোটামুটি সফল হয়েছে। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পশ্চাৎযাত্রা এবং চীনের প্রতি ঝুঁকে থাকার প্রবণতাকে ভালো চোখে দেখছে না বিশ্ব। ক্ষমতাসীন দল কীভাবে এই সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করবে- তা এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। লেখাটি ‘ইস্ট এশিয়া ফোরাম’ থেকে অনূদিত।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর