রাজধানীতে চার বছর ধরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন গাইবান্ধার সাবের আলী। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করছে তার তিন ছেলে-মেয়ে। প্রতিদিনের উপার্জনের টাকা কাছে না রেখে প্রতিদিনই স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেন বিকাশের মাধ্যমে। অথবা সঞ্চয় করেন নিজের বিকাশ অথবা নগদ একাউন্টে। এতে যেমন তার টাকা হারানোর ভয় থাকে না, তেমনি কোনো ঝামেলা ছাড়াই বাড়িতে পাঠানো যায়। শুধু সাবের আলী নন, তার মতো অনেক রিকশাচালক কিংবা নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কাছেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবা (এমএফএস) এখন যেন বড় আশীর্বাদ। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষই আর্থিক লেনদেনে বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকেই ঝুঁকছেন বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনও তাই বলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে লেনদেন হয়েছে ৭৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। এই লেনদেন একক মাস হিসেবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এর আগে একক মাস হিসেবে ২০২১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছিল ৭১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এছাড়া গত বছরের ডিসেম্বর মাসেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ড হয়েছিল; ৭১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে শহর থেকে গ্রামে বা গ্রাম থেকে শহরে তাৎক্ষণিকভা?বে টাকা পাঠানোর সুবিধা নিয়ে থাকেন দেশের সব শ্রমজীবী মানুষ। তাছাড়া ব্যাংকের ঝামেলা এড়াতে অনেকেই এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন শুধু টাকা পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দৈনন্দিন কেনাকাটা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধ ও মোবাইলে রিচার্জসহ নানা ধরনের সেবা মিলছে এর মাধ্যমে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতনও বিকাশ, রকেট কিংবা নগদের মতো বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে দিয়ে থাকে।
চলতি বছর জানুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ক্যাশ ইন অর্থাৎ টাকা পাঠানো হয়েছে ২২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। আর উত্তোলন করা হয়েছে -ক্যাশ আউট ১৯ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এমএফএস সেবায় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে ২০ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বাবদ বিতরণ হয় ২ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। বিভিন্ন পরিষেবার ১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকার বিল পরিশোধ হয় এবং কেনাকাটার ৩ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়।
বিকাশ, রকেট, নগদ, এমক্যাশ, উপায়সহ দেশে বর্তমানে ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা দিচ্ছে। সমপ্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৩টি এমএফএস সেবার হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, লেনদেন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট ও গ্রাহকের সংখ্যাও। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬৯। জানুয়ারি শেষে সেটা বেড়ে হয়েছে ১১ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৩০২। এসব গ্রাহকের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৬ কোটি ৩২ লাখ ও শহরের ৫ কোটি ৭ লাখ। নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ২৮ লাখ ৮১ হাজার ও নারী গ্রাহক ৫ কোটি ৮ লাখ ৪৯ হাজার। আর এই সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৩৫ হাজার ২১৩।
বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চে। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান চালু করে বিকাশ। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সিংহভাগই বিকাশের দখলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা পাঠাতে পারে। বিভিন্ন প্রয়োজনে জরুরিভাবে মানুষ এই সেবা নিয়ে থাকে। অর্থাৎ অর্থ লেনদেনের এই সহজ প্রক্রিয়াতে মানুষ ধীরে ধীরে আরও বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ফলে এর গ্রাহক যেমন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি লেনদেনও বাড়ছে। শহর থেকে গ্রামে কিংবা গ্রাম থেকে শহরে বিশেষ করে কম পরিমাণের লেনদেনগুলো মানুষ এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই করে থাকে। এছাড়া কেনাকাটা, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধেও এখন মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ তুলনামূলক বেড়েছে।