ঢাকা, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, রবিবার, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

সম্পর্কের স্বর্ণযুগে সীমান্তে হত্যার ধারাবাহিকতা

মো. তৌহিদ হোসেন
২১ মে ২০২৪, মঙ্গলবারmzamin

কয়েক বছর আগে যখন র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ উঠতো, প্রতিটি ঘটনার পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে একটি গল্প প্রচারিত হতো। বলা হতো সন্ত্রাসী কাউকে ধরার পর তাকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার সাঙ্গপাঙ্গরা র‌্যাবের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করে এবং র‌্যাব পাল্টা গুলি ছুড়লে ক্রসফায়ারে পড়ে সেই সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়। এই গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না, কিন্তু তারপরও বারবার এটাই প্রচারিত হতো।

৮  ই মে ২০২৪ তারিখে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা দু’দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরের আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করেন তিনি। এ ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। ৯ই মে তিনি দেশে ফিরে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করতে যেদিন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসেছেন, সেদিনই ভারতীয় বিএসএফ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সীমান্তে দু’জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে।  

কয়েক বছর আগে যখন র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ উঠতো, প্রতিটি ঘটনার পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে একটি গল্প প্রচারিত হতো। বলা হতো সন্ত্রাসী কাউকে ধরার পর তাকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার সাঙ্গপাঙ্গরা র‌্যাবের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করে এবং র‌্যাব পাল্টা গুলি ছুড়লে ক্রসফায়ারে পড়ে সেই সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়। এই গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না, কিন্তু তারপরও বারবার এটাই প্রচারিত হতো।

কে কার কাছ থেকে শিখেছে তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে, তবে এমন একটি গল্প অন্তত ২০ বছর ধরে শুনিয়ে আসছে বিএসএফ। দুই বাংলাদেশি নিহত হবার পর ৮ই মে দুপুরে বিজিবি এবং বিএসএফের মধ্যে ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠক হয়। পতাকা বৈঠকে বিএসএফ বলেছে, ১০ থেকে ১২ জন চোরাকারবারি কাঁটাতারের বেড়া কেটে ভারতে ঢোকে। বাধা দিলে তারা বিএসএফ সদস্যদের আক্রমণ করে এবং দুই পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে চোরাকারবারিরা বিএসএফ সদস্যদের দেশি অস্ত্র দিয়ে কোপ দেয়ার চেষ্টা করে। এতে আত্মরক্ষার্থে বিএসএফ গুলি চালায়, যার ফলে দুইজন নিহত হয়। (প্রথম আলো, ৯ই মে ২০২৪)।

বিএসএফের এই গল্পের পরিণতি যেমন করুণ, এর বক্তব্য তেমনি হাস্যকর। মানব চরিত্রের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আত্ম-সংরক্ষণ (সেলফ প্রিজারভেশন) যা এই বক্তব্যে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। চোরাকারবারিদের একটি দল যদি ভারতে প্রবেশ করে বিএসএফের একটি দলের মুখোমুখি হয়ে পড়ে, তাদের প্রথম সহজাত প্রবৃত্তি হবে প্রাণ রক্ষার্থে পলায়ন। তারা আক্রমণ বা ধস্তাধস্তিও করবে না, কোপ দেয়ারও চেষ্টা করবে না। তারা জানে যে, বিএসএফের হাতে প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র আছে এবং এটি একটি ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বাহিনী যারা হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালাবে। বিএসএফের এই শিশুতোশ গল্প ন্যূনতম বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাতে বিএসএফের কিছু আসে যায় না। তারা জানে, তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার টেবিলেও এই গল্পই বিবৃত করবে এবং চাইবে যে, বাংলাদেশ তা বিশ্বাস করুক।

সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। দু’দেশের মাঝে বিদ্যমান সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্পর্কও অনস্বীকার্য। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্বর্ণযুগ চলছে, নেতানেত্রীদের  মুখে এ বাক্যও পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হয়। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের মানুষের বেশ বড় একটা অংশ ভারতকে বন্ধু মনে করেন না। (বাংলাদেশের প্রতি অনেক ভারতীয়’র মনোভাবও তাই)। এর স্বপক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা যাবে না, কিন্তু চোখ-কান খোলা আছে যাদের তারা জানেন বিষয়টি সত্য। বিষয়টিকে দুঃখজনক বলছি এই কারণে যে, এমনটি হবার কথা ছিল না।

বাংলাদেশের জন্মলগ্নে দু’দেশের মাঝে গভীর সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা ছিল। দু’পক্ষের অনেকেই আমরা পরস্পরকে দোষারোপ করি এই পরিণতির জন্য। এ প্রসঙ্গে একটি পুরনো হিন্দি সিনেমার গানের মাঝখানে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া নায়ক নায়িকার দুটো সংলাপ মনে পড়ে। একজন বলছেন, দোষ কি শুধু আমারি ছিল? অন্যজনের উত্তর, কিছু দোষ তোমার ছিল, কিছু আমার ছিল, আর কিছু ছিল আমাদের দু’জনের। 

বাংলাদেশের মানুষের একাংশের মাঝে এই অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষেত্রেও সম্ভবত এই উপমা খানিকটা খাটে। তবে একটি বিষয়ে ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষের মনে তীব্র এবং স্থায়ী ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে, তা হলো সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি মানুষের নির্বিচার হত্যা। এই কথাটি আমি বহুবার বলেছি, আবারো বলছি, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত যুদ্ধরত নয় এমন দু’টি দেশের মাঝে পৃথিবীতে একমাত্র সীমান্ত যেখানে অসামরিক নিরস্ত্র মানুষকে সীমান্তরক্ষীরা নিয়মিত গুলি করে হত্যা করে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের পক্ষ থেকে এমনও বলা হচ্ছে যে, সীমান্তে যতদিন অপরাধ থাকবে ততদিন এই কাজ চলবে, আর বাংলাদেশও যেন তাদের যুক্তি অনেকটাই মেনে নিয়েছে। বিএসএফের সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এই দুষ্কর্মের প্রতিবাদের স্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে এখন প্রায় অনুচ্চারিত। চোরাচালানের মতো অপরাধ থাকে পৃথিবীর অনেক সীমান্তেই। সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে কোথাও মৃত্যুদণ্ড দেয়ার এবং তা তাৎক্ষণিক কার্যকর করার ক্ষমতা দেয়া হয় না।

ভারতীয় নেতৃত্ব রুটিন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে আসছেন সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার। ভারতের নিমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী যখন দিল্লি যাবেন, অনুমান করি এই প্রতিশ্রুতি আবার উচ্চারিত হবে। তবে তা নিকট ভবিষ্যতে বাস্তবে পরিণত হবে এতটা আশাবাদী হতে পারছি না।

লেখক: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব
১৬ই মে ২০২৪

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status