নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক
গোলাম সাকলায়েনদের ‘অনৈতিক সম্পর্ক’ এবং গাছ বাবার সন্ধানে!
ডা. আলী জাহান
২৮ জুন ২০২৪, শুক্রবারপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজী আনারকলির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা না নেয়া (অন্তত এ খবর মিডিয়ায় আসেনি) এবং জামালপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ‘হালকা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার’- কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেন এ দু’জনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? ভালো কথা, ব্যভিচারের যে বিচারের কথা বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে তা কি উনাদের ওপর প্রয়োগ হয়েছে? প্রয়োগ না হওয়ার কারণ? নাকি সরকারি কর্মকর্তা হলে বাংলাদেশের ফৌজদারি আইন তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়
১. চিত্রনায়িকা পরীমনির সঙ্গে ‘অনৈতিক সম্পর্ক রাখার কারণে’- পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে কিছু বলার আগে এই সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ‘গাছ বাবার’- মাজার সম্পর্কিত খবরটি একটু জেনে নেয়া যাক।
২. গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গজিনা গ্রামে শনিবার (২২.০৬.২৪) এক ‘অলৌকিক’ কাণ্ড ঘটেছে। শত শত মহিলা-পুরুষ দলবেঁধে গ্রামে হাজির। উদ্দেশ্য একটাই। সেখানে যে অলৌকিক গাছের খবর বেরিয়েছে সে গাছের কথা শোনার জন্য পুরুষ-মহিলা, যুবক, বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর সবাই দলবেঁধে গজিনা গ্রামে দৌড়ে আসছেন। গাছের সঙ্গে কান লাগিয়ে তার দুঃখ বোঝার চেষ্টা করছেন। কেউ একজন নাকি গাছের কান্না শুনতে পেয়েছে। তারপর আর যায় কোথায়। বাতাসের বেগে সে উদ্ভট কথা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। গাছের কথা শোনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ‘ঐতিহাসিক’- সে গ্রামে হাজির হতে থাকে। মিডিয়ায় খবর রটে যায়। বেড়া দিয়ে মাজার বানানোর প্রস্তুতি চলে। শেষমেশ পুলিশের তদারকিতে গাছটি কেটে ফেলা হয়। গাছ বাবার মাজারের এখানেই সমাপ্তি। খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলে প্রশাসন বাগড়া দিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, গাছের কথা শোনার জন্য যারা এসেছিলেন তারা কেন এলেন?
৩. ইংল্যান্ডে আমি এক ছেলেকে জানি যে, পাখির সঙ্গে কথা বলে। গাছের পাতার সঙ্গে কথা বলে। ছেলেটি উড়তে পারে না। তাই পাখির সঙ্গে সহমর্মিতা জানাতে সে তার চুলে এবং নাকের ছিদ্রে পাখির পেখম লাগিয়ে ঘোরাঘুরি করে। গাছের পাতা দিয়ে তৈরি টুপি ব্যবহার করে। আমি নিজের চোখেই তাকে বাগানে পাখির সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি, গাছের সঙ্গে গল্প করতে দেখেছি। ছেলের পরিচয় একটু পরে দেবো। তার সঙ্গে আমার পরিচয় কীভাবে হলো তার বিস্তারিত বলবো।
৪. বিবিসি বাংলার খবর অনুসারে গোলাম সাকলায়েন ও চিত্রনায়িকা পরীমনির মধ্যে ‘অনৈতিক প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং তিনি নিয়মিত পরীমনির বাসায় রাত্রিযাপন শুরু করেন’। খবর অনুসারে পুলিশের এ কর্মকর্তা বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক। বিবাহ-বহির্ভূত এ সম্পর্ককে আইনের ভাষায় ‘adultery’ বলা হয়। বাংলাদেশি আইনে এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। শাস্তি হচ্ছে ৫ বছরের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু ফৌজদারি অপরাধের কী হবে? ৫ বছরের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড কিছুই হবে না? ভালো কথা, গোলাম সাকলায়েনই কি সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রথম এ অপরাধটি করলেন? এর আগে কেউ করেননি? তাদের ব্যাপারে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল? প্রশাসনিক ব্যবস্থা মাঝে-মধ্যে নেয়া হয়েছে, কিন্তু ফৌজদারি অপরাধের কী হলো?
৫. সরকারি চাকরিরত অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা খুব ছোট নয়। সে তালিকা থেকে আমি মাত্র দু’টি উদাহরণ দেবো।
৬. আগস্ট ২০২২। বাসায় মাদকদ্রব্য রাখার অভিযোগে এবং ‘অনৈতিকভাবে নাইজেরিয়ান বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে লিভ টুগেদার করার কারণে’- ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন কাজী আনারকলিকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়া সরকার অভিযোগ উত্থাপন করে। বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে। কূটনৈতিক সুরক্ষা আইন থাকার কারণে জাকার্তা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি, তবে বাসা রেড করে। তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম মিডিয়াকে বলেছিলেন- ‘তদন্ত চলছে এবং তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে কঠিন শাস্তি মোকাবিলা করতে হবে’। ‘চৌকস’- এ নারী কর্মকর্তাকে এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে প্রত্যাহার করে দেশ আনা হয়েছিল। গৃহকর্মী নিখোঁজের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ ছিল। প্রায় দুই বছর হয়ে গেল! জাকার্তা মিশনের তদন্তের খবর কী? উনি কি দোষী ছিলেন, না ফেরেশতা ছিলেন? কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধে? কোনো খবর নেই। সেগুনবাগিচায় অবস্থিত পররাষ্ট্র দপ্তরের অফিস এখানে বড্ড নীরব!
৭. ২২শে আগস্ট ২০২১। তৎকালীন জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবিরকে এক মহিলার সঙ্গে সরকারি অফিসে আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়ার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। মিডিয়ায় প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হয়। বাধ্য হয়ে সরকার জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে। মার্চ ২০২১ সালে কবির সাহেবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর সে শাস্তি হচ্ছে ওএসডি থেকে এক ধাপ নামিয়ে উপ-সচিব পর্যায়ে নিয়ে আসা। পরবর্তী জীবনে আর কোনো পদোন্নতি না পাওয়া। ব্যাস, এখানেই গল্পের সমাপ্তি।
৮. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজী আনারকলির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা না নেয়া (অন্তত এ খবর মিডিয়ায় আসেনি) এবং জামালপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ‘হালকা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার’- কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেন এ দু’জনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? ভালো কথা, ব্যভিচারের যে বিচারের কথা বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে তা কি উনাদের ওপর প্রয়োগ হয়েছে? প্রয়োগ না হওয়ার কারণ? নাকি সরকারি কর্মকর্তা হলে বাংলাদেশের ফৌজদারি আইন তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়?
৯. গোলাম সাকলায়েনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে পুলিশের যে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত তা পিএসসি অনুমোদন করতে পারে, নাও করতে পারে। নিকট অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, পিএসসি তা অনুমোদন করলেও আইন আদালতের মারপ্যাঁচে পুলিশের এ অভিযুক্ত কর্মকর্তার ফেরেশতা হয়ে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা প্রবল। শুধুমাত্র কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ‘প্রেমকে’- এখনই কবরে পাঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না!
১০. আমার মনে হচ্ছে যে, গোলাম সাকলায়েনের সঙ্গে চিত্রনায়িকার ঘনিষ্ঠতার ভিডিও প্রকাশ না পেলে তার কিছুই হতো না। ভিডিও প্রকাশটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্দার অন্তরালে এবং প্রকাশ্যে আধুনিকতার নামে কেউ কেউ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে adultery কে সমর্থন করলেও তাদেরকে থামানোর কেউ নেই। সে হিসেবে গোলাম সাকলায়েনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করার কোনো কারণ নেই।
১১. ইংল্যান্ডে আমি যে ছেলেটির কথা বললাম সে কিন্তু আমার রোগী। মানসিকভাবে অসুস্থ। মেডিকেলের ভাষায় সে সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। কাজেই সে যখন পাখির সঙ্গে, গাছের সঙ্গে কথা বলে আমরা অবাক হই না। আমরা জানি যে সে বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কাল্পনিক জগতে আছে। তার চিকিৎসা দরকার। সে আমার হাসপাতালের রোগী।
১২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজী আনারকলি, জামালপুরের সাবেক ডিসি আর পরীমনি কাণ্ডের নায়ক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনের ব্যাপারটি পর্যালোচনা করে আমি বুঝতে পারি মানুষ কেন গাছের কথা শুনতে চায়। গাছের সাথে কথা বলতে চায়। গাছের সুখ-দুঃখের কাহিনী জানতে চায়। মানুষের ওপর থেকে তারা বিশ্বাস হারিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের বয়ান আর শুনতে চায় না। বিশ্বাস করতে চায় না। সে কারণেই তারা ‘Schizophrenia’রোগীর মতো আচরণ করতেও ভয় পাচ্ছে না।
১৩. আইনের অপ-প্রয়োগ দেখে মানুষের ওপর থেকে কি মানুষ বিশ্বাস হারিয়েছে? বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা দিয়েছে যে, ক্ষমতাসীনদের কথা শুনতে নেই। বিশ্বাস করতে নেই। আর সে কারণেই হয়তো গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গজিনা গ্রামে গাছ কথা বলছে- এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পঙ্গপালের মতো ঐদিকে দৌড়িয়েছে। এবং সামনেও দৌড়াবে।
১৪. বাংলাদেশের সমাজের কিছু অংশ কি আসলেই P S Y C H O T I C? মানুষ যখন প্রচলিত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্নভাবে বিশ্বাস ও ব্যবহার শুরু করে এবং তাদের কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো যায় না, তখন তাকে আমরা বলি psychosis. প্রশ্ন হচ্ছে আসল সাইকোটিক লোক কারা?
লেখক: কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য।
সাবেক পুলিশ সার্জেন্ট, যুক্তরাজ্য পুলিশ।
সাবেক সরকারি (বিসিএস) কর্মকর্তা, বাংলাদেশ।
[email protected]
পুরা দেশটা 'সাইকো' এ ভরে গেছে আপনি কাকে ছেড়ে কার কথা বলবেন।