নির্বাচিত কলাম
এমন সময় কী দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমরা?
শেরিফ ফারুকী
২০ জুলাই ২০২৪, শনিবারঅবিশ্বাস্য অথবা তার চেয়ে বেশিকিছু। ১৭ই জুলাই থেকে ১৯শে জুলাই এ লেখা প্রকাশ হওয়ার সময় পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর বেশির ভাগ ছাত্র। একটা ছাত্রের বুকের উপর গুলি করার আগে আপনারা একবারও ভাবলেন না?
কেন এমন হলো? কেন প্রাণ হারালো এতগুলো ছেলে? কে জবাব দেবে এর। কোনো জবাব নেই। আছে শুধু হতাশা, নৈশব্দের ভেতরে আমরা যেন ডুবে যাচ্ছি। কী হয়নি এবার? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছেলের হাত, পিঠ ও পা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে গর্ত করে ফেলা হয়েছে। রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়ার কী দরকার ছিল? আমি জানি না। এ নির্মমতা শেষ কবে বাংলাদেশ দেখেছিল। ১৯৭১-এ? সম্ভবত।
পিতার কাঁধে পুত্রের লাশের চেয়ে ভারী আর কী আছে? আর মা? পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দেয়া আবু সাঈদের মা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘ছোল মোর কেবল পায়ে দাঁড়িয়ে উঠছিল...যাই মারছে তার ফাঁসি হবি?’ এত এত লাশের পর ছাত্রনেতাদের বাধ্য করা হচ্ছে সংলাপে বসতে। কিন্তু কীসের সংলাপ? কার সঙ্গে? লাশের বদলে সংলাপ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পুলিশ ঢোকেনি বহুকাল। সেখানে ভিসির অনুমতিতে পুলিশকে ঢুকতে দেয়া হলো ছাত্রদের গুলি করতে। অবিশ্বাস্য, কলঙ্কজনক এবং মেনে নেয়ার মতো না। এমন দেশ দেখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ফারহান ফাইয়াজ নামের ছেলেটার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে আপনি তাকিয়ে থাকতে পারবেন না। এই ছেলেকে খুন করা হলো। কীভাবে কখন কোন পরিস্থিতিতে একটা কিশোরের দিকে বন্দুক উঁচানো যায়? একটা যুদ্ধেও কী সম্ভব? ঠাণ্ডা মাথার কোনো খুনে জেনারেলের পক্ষেও হয়তো সম্ভব না।
একটা স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। অথচ এখানে গত তিনদিন ধরে ঘর থেকে বের হতে ফোন চেক হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের রামদা দিয়ে কুপিয়ে, অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে যেভাবে আহত করা হচ্ছে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হচ্ছে। কাদের উপর গুলিটা করছেন? আপনার দেশের নাগরিকদের উপর। কেন?
অ্যাম্বুলেন্সে করে শিক্ষার্থী নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। গুলি হলো সেই অ্যাম্বুলেন্স চালকের উপর। জাবির প্রক্টর কেঁদে কেঁদে চিৎকার দিয়ে বলছেন, ‘আমার ছেলেদের উপরে যা হচ্ছে আপনি এর নমুনা কোথাও পাবেন না।’ একটা শিক্ষককে এরচেয়ে অসহায় অবস্থায় আমি আর কখনো দেখিনি। লাশ আসছে। লাশ নিয়ে মিছিল হচ্ছে। খবর আসছে একের পর এক। আর কতো লাশ গোনা যায়?
বন্ধুদের কাছ থেকে ফোন পাচ্ছি। ওরা সবাই আন্দোলনে। আমি একা ছটফট করছি। আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। মা ফোন করছে, ভাই ফোন করছে, আমি কী-বোর্ডে খটাখট লিখছি। যে ছেলেটা রাস্তায় বুক পেতে দাঁড়িয়ে গেল, যে ছেলেটা সেøাগান দিতে দিতে শুয়ে পড়লো সে ছেলেটার ছবির দিকে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। ওই ছেলেটার মা কি করছে? বোন কি করছে? ওরা কীভাবে সহ্য করবে এমন শোক?
ছেলেদের কী দাবি ছিল? খুব ছোট একটা দাবি। ওরা চায় বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার একটা যৌক্তিক সংস্কার। সে দাবি তো ২০১৮ সালেই সমাধান হয়েছিল। তারপর কেন আবার কিছু ছেলের প্রাণ কেড়ে নেয়ার জন্য কোটা আনা হলো ঠিক জানি না। কোন যুক্তিতে দেশকে গাজার মতো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে হলো বুঝতে পারছি না। একটা দেশ এত এত রক্তের উপর দিয়ে স্বাধীন হলো তারপর আবার কেন বার বার রক্ত ঝরাতে হবে?
হাসান মেহেদী নামের যে সাংবাদিককে গুলি করা হলো তার মাথা ও বুকে গুলি ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য কীভাবে একজন সাংবাদিক হিসেবে সহ্য করতে পারি? অসংখ্য সাংবাদিক আহত হয়েছেন। সাংবাদিকদের পেটানো হয়েছে, টিয়ারশেল মারা হয়েছে। মুখ চেপে ধরা হয়েছে সংবাদমাধ্যমের। সাময়িক সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের। বন্ধ করা হয়েছে ওয়াইফাই পর্যন্ত। পুরো দেশকে অন্ধকারে রেখে কী প্রমাণ করতে চাচ্ছে সরকার?
এই লাশের খেলা শেষ হোক। শেষ হোক এমন বীভৎস সংস্কৃতির। দেশটা আমাদের সবার। লাশের উপর দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ গড়া যাবে না।
জনগনের জান মালের নিরাপত্তা দেয়া যাদের কাজ তারাই কিনা ছাত্রজনতাকে হত্যা করছে। এইজন্যই কি আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিল, জীবন দিয়েছিল? এমন নিষ্ঠুর, বর্বর রেজিম গনতান্ত্রীক পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।