ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

শাকিলের মৃত্যু

শেষ একটি পরিবারের স্বপ্ন

ফাহিমা আক্তার সুমি
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবারmzamin

সন্তান হারানোর এই যন্ত্রণা কীভাবে কমবে? আমার সন্তান যে বিছানায় ঘুমাতো সেই বিছানায় এখন আমি ঘুমাই। যে টেবিল-চেয়ারে বসে পড়াশোনা করতো ওইখানে আমি বসি। দরজায় কলিংবেল বাজলে মনে হয় দরজা খুললে ‘আব্বু’ বলে শাকিল জড়িয়ে ধরবে। সবসময় মনে হয় ‘আব্বু আব্বু’ বলে আমার সন্তান ডাকছে। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেছিলাম। ওরা আমার বুকের মানিককে কেড়ে নিলো। ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার ইচ্ছা ছিল শাকিলের। পড়াশোনা শেষে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে। বাবা-মাকে অনেক যত্নে রাখবে। একমাত্র সন্তানকে হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন শাকিলের বাবা-মা। গত ১৮ই জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হন মো. শাকিল হোসেন। তিনি মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী ছিলেন।

নিহত শাকিলের বাবা বেলায়েত হোসেন মানবজমিনকে বলেন, পরিবারে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমার পরিবারের আলো ছিল শাকিল। তার পড়াশোনা শেষের দিকে ছিল। আমার ইচ্ছা ছিল শাকিলের একটা ভালো চাকরি হবে, আগামী বছর তাকে বিয়ে দিবো। একসময় গ্রামে একটা বাড়ি করবো। ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর বাকি জীবনযাপন সেখানে কাটাবো। এখন আমাদের কে দেখবে? ১৯৭১ সালের যুদ্ধে আমার মা শহীদ হয়েছেন। ২০২৪ সালে আমার সন্তান শহীদ হয়েছে। আমি একজন শহীদের পিতা এবং একজন শহীদ মায়ের সন্তান। এইরকম ভাগ্য সবার হয় না। আমার সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে নিজের জন্য নয়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বেলায়েত হোসেন বলেন, শাকিল আমার একমাত্র হিরার টুকরো ছিল। তিন মেয়ের পরে সে ছিল আমার একমাত্র ছেলে। আমার সন্তান এমন ছিল কারও বিপদ দেখলে আগে দৌড়ে এগিয়ে যেতো। সে এই বয়সে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। হাজার হাজার মানুষ তার জানাজায় অংশ নিয়েছে, কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল আমার সন্তানের মৃত্যুতে। ওর মা পারভীন আক্তার দীর্ঘ আট বছর ধরে শয্যাশায়ী। দুইবার স্ট্রোক করে প্যারালাইসেস হয়ে গেছে। এখন সন্তানের শোকে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ৩৬ বছর ধরে পরিবার নিয়ে টঙ্গীতে ভাড়া থাকি। সেখানে ছোট একটা ব্যবসা করি। সন্তানদের নিয়ে ছিল আমার বসবাস। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সব বাবা-মায়ের একটা স্বপ্ন থাকে সন্তানদের নিয়ে। ওর স্বপ্ন ছিল ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার। আমার সন্তান কতো রক্ত যে দিয়েছে মানুষের জীবন বাঁচাতে। সব সময় এসকল মানবিক কাজে আমি তাকে উৎসাহ দিতাম। সে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শুরু থেকেই মাঠে অনড় ছিল।

শহীদ সন্তানের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, আমার বুকে যে একটা যন্ত্রণা আছে সেটি কীভাবে মুছে ফেলবে। কীভাবে কমবে আমার বুকের যন্ত্রণা। তার পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বইগুলো ছুঁয়ে দেখি । তার জামা-কাপড়গুলো সাজিয়ে রেখেছি সুন্দর করে। ওর সাজানো সবকিছুর দিকে তাকালে মনে হয় আমার শাকিল আছে, ঘোরাঘুরি করছে। বাজারের দিকে গেলে অনেক লোকজন দেখলে মনে হয় আমার শাকিলও দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইলে কোনো কল আসলে মনে হয় আমার শাকিল কল দিয়েছে কিছু বলার জন্য। এই অনুভবগুলো রাত-দিন আমার সঙ্গে ঘুরছে। কখনো মনে হচ্ছে না আমার সন্তান মারা গিয়েছে। 

বেলায়েত হোসেন বলেন, গত ১৮ই জুলাই বিকাল সাড়ে চারটার দিকে পুলিশের গুলিতে উত্তরা আজমপুর থানার সামনে শহীদ হয়েছে আমার সন্তান। তখন আমি লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। উত্তরা পূর্ব থানার দিক থেকে তাকে গুলি করে। ঘটনার দিন আছরের নামাজ শেষ করে বের হই তখনই আমার মোবাইলে কল আসে। কল দিয়ে পরিচিত একজন বলে আঙ্কেল আপনি দ্রুত উত্তরা মেডিকেলে আসেন। তখন আমি জানতে চাই কেন কি হয়েছে? এ সময় তারা বলে আমাদের বন্ধু শাকিল অসুস্থ গুলিবিদ্ধ হয়েছে আপনি দ্রুত আসেন। তখন আমি বলি, দেখো আমার শাকিল যদি অসুস্থ হতো তাহলে এভাবে আমাকে বলতো না। আমার শাকিলের কি হয়েছে সেটি বলো। তখনই তার মৃত্যুর কথা আর আড়াল না করে ওরা আমাকে সত্যিটা বলে। ওর বন্ধুরা ও মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শাকিলকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা জানায় শাকিল আর বেঁচে নেই। পরে তারা আমার অনুমতি নিয়ে সব প্রস্তুতি শেষে জানাজা করিয়েছিল। এরপর টঙ্গী নিয়ে এসে আবার জানাজা হয়। এরপর দীঘির পাড়ে আরেকটি জানাজা হয়। গাজীপুর তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় আগে পড়াশোনা করতো শাকিল। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আমার সন্তানের মরদেহ নিয়ে আরেকবার জানাজার আয়োজন করেন। তখন রাত ১২টা বাজে। আমি গ্রামের বাড়িতে থাকা অবস্থায় তাদের সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে যোগাযোগ ছিল। ওই রাতেই আমার সন্তানের মরদেহ নিয়ে ছাত্র-শিক্ষকরা আমার গ্রামের বাড়িতে রওনা দেন। সন্তানের অপেক্ষায় আমি গৌরিপুর ব্রিজের নিচে এসে দাঁড়াই। পরের দিন শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় গিয়ে লক্ষ্মীপুরে পৌঁছায়। আমি বাবা কীভাবে সহ্য করবো আমার সন্তানের এই মর্মান্তিক মৃত্যু। একটা গুলি আমার সন্তানের বুকে লেগে পেছন থেকে বেরিয়ে যায়। আর মুখমণ্ডলসহ সারা শরীরে ছিল ছররা গুলির চিহ্ন। 
 

পাঠকের মতামত

মহান আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা 'শাকিল' সহ ২০২৪ইং সালের সকল বীর শহীদদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।

মোস্তাফিজুর রহমান।
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ১১:৫৭ পূর্বাহ্ন

খূনীদের ফাসি চাই

আইয়ুব
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ৭:৩২ পূর্বাহ্ন

মহান আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা 'শাকিল' সহ সকল বীর শহীদদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।

MD EMAMUL MOSTAFA
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:০৭ অপরাহ্ন

স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদের দিনলিপির অন্যতম এজেন্ডা ছিল ছাত্র হত্যা। শিক্ষার্থী, জ্ঞান ও শিক্ষাকে ধ্বংস করে তারা ক্ষমতাক্ষে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল। জনরোষে পালিয়ে আপতত রক্ষা পেলেও বিচারের মুখোমুখি দাড় করানোই হোক সবার ব্রত।

Mahmud Eusuf
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

এক একটা গল্প যেন এক একটা দেশ প্রেমিকের স্বপ্নের অশ্রুসিক্ত ঝরে যাওয়া।

mokbul
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৯:০০ পূর্বাহ্ন

মহান আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা 'শাকিল' সহ সকল বীর শহীদদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।

ফখরুল ইসলাম।
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৮:০২ পূর্বাহ্ন

ইউটিউব এর এক ভিডিও তে দেখলাম জনগণ শিক্ষকদের পদত্যাগে মর্মাহত, কিন্ত এইসব সূর্য সন্তান দের আত্মত্যাগ তাদের কাছে গৌণ । ইউটিউবার সেই কথাটি আক্ষেপ করেছেন। বাঙালী বড়ই আজব । দুই দিন পর অতি মর্মান্তিক ঘটনা ও তাদের কাছে আর মূল্যবান থাকে না

Kazi
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:৪১ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status