ঢাকা, ৭ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

পিওন থেকে ১০ জাহাজের মালিক খুলনার তুহিন ঠাকুর

রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবারmzamin

শাহ আলম ঠাকুর তুহিন। নামে ঠাকুর হলেও তার পেশাক-আশাকের কারণে খুলনার অনেকেই তাকে দরবেশ বলে ডাকেন। এক সময় ছিলেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ডক শ্রমিক ইউনিয়নের পিওন। মাত্র দেড় যুগের মধ্যে রূপকথার মতো হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। দেশি ও আর্ন্তজাতিক রুটে চলে তার ১০টি পণ্যবাহী জাহাজ। ঢাকা, খুলনা ও ফরিদপুরের নগরকান্দায় রয়েছে আলীশান বাড়ি। তার এই সবকিছুর শক্তি যুগিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল ইদ্দিন, শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেল। শুধু তাই না, নিজেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে মোংলা বন্দর এলাকা দাপিয়ে বেড়াতেন। শেখ পরিবারের আশির্বাদ নিয়ে বিনা ভোটে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাষ্ট্রি ও জাহাজ মালিকদের সংগঠন খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন মালিক গ্রুপের পরিচালক হন। তিনি ছিলেন মোংলা বন্দরের অঘোষিত ডন। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন এই ধনকুবের।

কে এই তুহিন ঠাকুর: অনুসন্ধানে জানা যায়, তুহিন ঠাকুরের বাবা ঠাকুর আবুল বাশার ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইন গ্রাম থেকে মোংলায় আসেন। তিনি ছিলেন মোংলা বন্দরের ডক শ্রমিক। বাবার কারণে নব্বই দশকের শেষের দিকে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ডক শ্রমিক ইউনিয়নের পিওন হিসেবে চাকরি পান। সুচতুর তুহিন চাকরির পাশাপাশি মোংলা সেনাকল্যাণ সংস্থা ও বসুন্ধরা সিমেন্ট মিলে ব্রোকারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর ২০০৬ সালে চাকরি ছেড়ে নৌ-পরিবহনে দালালি শুরু করেন।

যেভাবে উত্থান: ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার ভাগ্য খুলে যায়। এ সময়ে বাগেরহাটের সংসদ সদস্য ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিনের মালিকানাধীন খানজাহান আলী পরিবহনের ‘এমভি তন্ময়’, শেখ হেলালের স্ত্রী রূপা চৌধুরীর মালিকানাধীন অনন্যা করপোরেশনের ‘এমভি অনন্যা-১, ‘এমভি আনমনা’ নৌ-যানে কমিশন ভিত্তিক কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে তার ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের মালিকানাধীন ‘আজমীর নেভিগেশন এন্ড কোম্পানির নৌযান ‘এমভি জয়নাব বাতুল, এমভি শেখ ফারদিন ও এমভি নাজিলা মরিয়ম’-এ  কাজ করেন। তখন থেকেই শেখ পরিবারের আশির্বাদ নিয়ে মোংলা বন্দরের নৌ-পরিবহনে ঠিকাদারী কাজ বাগিয়ে নিতে থাকেন। শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল সার্বক্ষণিকভাবে খুলনায় না থাকার কারণে তাদের ব্যবসার তদারকির ভার পড়ে তার উপর। তখন সে নিজেকে শেখ পরিবারের লোক বলে ব্যবসায়ী সেক্টরে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। প্রথমে জাহাজ ভাড়া নিয়ে পণ্য পরিবহন করতেন। এরপর ধীরে ধীরে ১০টি পণ্যবাহী জাহাজের মালিক হন।
তুহিন ঠাকুরের মালিকানাধীন  জাহাজ: তুহিন ঠাকুরের মালিকাধীন ১০টি জাহাজ থাকলেও অনুসন্ধানে ৭টি পণ্যবাহী লাইটার ভ্যাসেল (জাহাজ)এর নাম জানা গেছে। জাহাজের মধ্যে রয়েছে ২ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এমভি আবুল বাশার, এক হাজার টন ধারণ সম্পন্ন রয়েছে ৫টি জাহাজ। এগুলো হচ্ছে- এমভি তন্নি, এমভি তামিম, এমভি সোহাগ, এমভি সুলতানা চাঁদনী ও এমভি সুমি সুলতানা। সবচেয়ে বিলাসবহুল দেড় হাজার টন এমভি নগরকান্দা। এসব জাহাজগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করছে। এ ছাড়াও মেসার্স শিপিং লাইন্স ও মেসার্স আই এফ এস লজিস্টিকাস নামে দু’টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বিলাসবহুল বাড়ি ও ফ্ল্যাট: তুহিন ঠাকুরের খুলনা মহানগরীর আজম খান কমার্স কলেজের সামনে বিলাসবহুল ‘নান্দিক আবেদীন ভিলায়’ রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট, রায়পাড়া গফ্‌ফারের মোড়ে রয়েছে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, মিস্ত্রিপাড়া বাজারের কাছে রয়েছে আরও একটি বাড়ি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে রয়েছে জমি। মিরপুরে রয়েছে দু’টি ফ্ল্যাট। ফরিদপুরের নগরকান্দায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাগানবাড়ি। এ ছাড়া নগরকান্দায় কাইচাইন গ্রামে বিশাল এলাকা জুড়ে জমি কিনে গড়ে তুলেছেন ‘তুহিন নগর’।

যেভাবে কাজ হাতিয়ে নিতেন: বহুরূপী তুহিন ঠাকুর একসময় মোংলা বন্দরের পিওন থাকলেও শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েলের দাপটের কারণে মোংলা বন্দরে অঘোষিত ডন বনে যান। তিনি বন্দরে ঢুকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হতো। এক সময় যেসব কর্মকর্তাদের স্যার বলে স্বম্বোধন করতেন তারাই তুহিন ঠাকুরকে দেখলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে বাধ্য হতেন। বন্দরের নৌ-পরিবহনের অধিকাংশ কাজ বাগিয়ে নিতো তার মালিকানাধীন মেসার্স ইস্টার্ন কেরিয়ার্স। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল ছাড়াও অপর ৩ ভাইয়ের রয়েছে আরও জাহাজ। শেখ সোহেলের মালিকানাধীন শেখ নাবিলা করপোরেশন, শেখ রুবেলের মালিকানাধীন জালাল করপোরেশন এবং শেখ বেলাল উদ্দিন বাবুর মালিকানাধীন অহনা করপোরেশনের পণ্যবাহী জাহাজ দেখাশুনা করতেন এই তুহিন ঠাকুর। অভিযোগ রয়েছে শেখ পরিবার ও তুহিন ঠাকুরের জাহাজে পণ্য সরবরাহের পর অন্যান্য মালিকরা পণ্য সরবরাহের কাজ পেতেন। ফলে অনেক ব্যবসায়ীর নৌযানগুলো দিনের পর দিন অলস পড়ে থাকতো। শেখ পরিবারের দাপটে অনেকেই নিজের ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছেন।

সিটি মেয়রের ব্যবসায়িক পার্টনার: জানা গেছে, বসুন্ধরা গ্রুপের ‘বিটুমিন’ এর পদ্মার এপারে একমাত্র পরিবেশক তুহিন ঠাকুর। এ কারণে তিনি খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। ফলে মেয়রকে দিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারদের বাধ্য করতেন তার ‘বিটুমিন’ কেনার জন্য। এ থেকে বড় অংকের কমিশন পেতেন সাবেক এই মেয়র।
তুহিন ঠাকুরের প্রভাব বিস্তার ও অপকর্ম সম্পর্কে জানতে চাইলে কয়েকজন ব্যাবসায়ী বলেন, তুহিন ঠাকুরের জোরজবরদস্তি করে কাজ বাগিয়ে নেয়ার প্রতিবাদ করলে অনেকেই নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। একাধিক নৌ-পরিবহনের মালিক অপকর্মের প্রতিবাদ করায় তাদের বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে হুমকি-ধমকি প্রদান করেতো তুহিন ঠাকুর। 

অভিযোগ রয়েছে, আমদানিকারক ও মোংলা বন্দরের কর্মকর্তাদের হুংকার দিয়ে বলতেন ‘এমপি হেলাল সাহেব ও এমপি জুয়েল সাহেবের নির্দেশে আমি এসেছি, ‘দেশ চলে এখন তাদের কথায়’। ‘আর তাদের কথার বাইরে মোংলা বন্দরের পানিও নড়বে না’। তার এ দাপটের কারণে বন্দরের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা ছিলেন অসহায়। তাছাড়া ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট পর্যন্ত বিভাগীয় নৌ-পরিবহন মালিক গ্রুপটি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাইদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন সাবেক এমপি শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। ২০১৭ সাল থেকে সরকার পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন তার ভাই শেখ সোহেল। কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন তার আরেক ভাই শেখ রুবেল। তারা সবাই প্রভাব খাটিয়ে ভোট ছাড়াই এ পদ দখল করেন।
শুধু তুহিন ঠাকুরই নয়, খুলনায় শেখ পরিবারের আশির্বাদপুষ্ট ডজন খানেক ব্যক্তি শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন। তারা অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধেও রয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এদিকে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহ আলম ঠাকুর তুহিন প্রথমে বলেন, মোংলা বন্দরে আমার কোনো ব্যবসা নেই, কোনো জাহাজও নেই। পরে তিনি স্বীকার করেন তার দু’টি ভেসেল জাহাজ, স্ত্রীর নামে একটি জাহাজ, মেয়ের নামে একটি ও ছেলের নামে একটি জাহাজ রয়েছে। তিনি বলেন, শেখ পরিবারের সঙ্গে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যে সম্পর্ক রয়েছে আমার সঙ্গে একইভাবে সম্পর্ক। আমি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে এ অবস্থায় এসেছি।

 

পাঠকের মতামত

শেখ পরিবার হচ্ছে পরশপাথর। এদের সংস্পর্শে আসলেই ন্যূনতম হাজার কোটি টাকার মালিক। ভাগ্য ভালো এরা গোটা দেশটাকে খেয়ে ফেলেনি।

mc
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ৯:৩৪ অপরাহ্ন

আহা চোরটার কি নুরানি চেহারা। কে বলবে দেশ ধংসকারি এক ইবলিশ লুকিয়ে আছে এই শয়তানের ভিতরে।অবিলম্বে গ্রেফতার করে সমস্ত সম্পত্তি যব্দ করে সরকারের নিয়ন্ত্রনে নেওয়া দরকার

Aminur rahman
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন

এই দুর্নীতিবাজ, লেবাসধারী ভন্ডের এই দাড়ি টুপিওয়ালা ছবি দিয়ে যারা সাধারণ সৎ ন্যায়পরায়ণ মুসলমান তাদের ব্যপারে সবার মনে নেগেটিভ মনোভাব তৈরী যেন না হয় সে ব্যপারে সতর্ক থাকা উচিৎ। এই লেবাসধারী ভন্ডকে ধরে ওর দাডি চেছে তারপর আইনের হাতে তুলে দেয়ার ছবি দেখতে চাই। এইসব লেবাসধারী চোরদের সমাজে স্থান নেই।

মো:নিজাম খান
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ৭:৪৩ পূর্বাহ্ন

সাবেক MP শেখ জুয়েলের বন্ধু তারেক ,বাবু,গৌতম লস্কর ,পি এস জাহিদ ( শ্যালোক রেনী, সাগর ,ওপু,)কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে ,এদের বিচাৱ করুন.

মঈন
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ১:৫৩ পূর্বাহ্ন

তদন্ত করে অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সরকারি কোষাগাড়ে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।

Kazi
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ১:৩৮ পূর্বাহ্ন

সেখ জুয়েলের বনধু তারেক , গৌতম লসকর , জাহিদ,রেনী , শালা অপু ,সাগর ,এরা অনেক কোটি টাকার মালিক

তুহিন
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ১:১৫ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status