প্রথম পাতা
গুলিতে আলী হোসেনের মৃত্যু
দুই সন্তানকে নিয়ে অন্ধকার দেখছেন রত্না
ফাহিমা আক্তার সুমি
৭ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবারআলী হোসেন। জীবিকার জন্য কাজ করতেন একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে। ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। গুলিটি বুকের ডান পাশে বিদ্ধ হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাত সাড়ে দশটার দিকে মারা যান। সাত ভাইবোনের মধ্যে আলী হোসেন ছিলেন সবার ছোট। তার ছোট দুই সন্তান রয়েছে। বাবা মো. ইদ্রিস মারা গেছেন বহুবছর আগে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ভাড়া বাসায়। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন আলী। তার মৃত্যুতে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না স্ত্রী রত্না বেগমের। আলীর মৃত্যুতে পুরো পরিবারটিতে নেমে এসেছে অন্ধকার।
আলী হোসেনের ভাই আলী আকবর মানবজমিনকে বলেন, ১৯শে জুলাই বিকালের দিকে নিউমার্কেট এলাকায় বিকাল পাঁচটার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় আমার ভাই। সন্ধ্যায় আমরা খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। একটা গুলি আমার ভাইয়ের বুকের ডান পাশে লাগে। সেদিন নিউমার্কেট এলাকায় অনেক গোলাগুলি হয়। আমাদের ভাইবোনের মধ্যে আলী ছিল সবার ছোট। রাতুল (১৩) ও ফাহিম (৬) নামে তার দুই সন্তান রয়েছে। আমাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। বাবা অনেক আগে মারা যান। মায়ের বয়স হয়েছে, তার সব ছোট সন্তানকে হারিয়ে একদম ভেঙে পড়েছেন। আমরা সব ভাইবোন কামরাঙ্গীরচরে পাশাপাশি থাকি। ওর সন্তানরা বাবাকে হারিয়ে অসহায় জীবন-যাপন করছে। বড় ছেলেটি মাদ্রাসায় পড়তো ওর বাবা মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে নিয়ে এসেছি। সন্তানরা সব সময় বাবার কথা বলতে থাকে, বাবার জন্য কাঁদে।
তিনি বলেন, আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যান তখন আলী হোসেন অনেক ছোট ছিল, কিছুই বুঝতো না। বাবা মারা যাওয়ার পরে আমিই ভাইটিকে মানুষ করি। আমাদের পারিবারিক অবস্থা এত ভালো ছিল না। বাবা একটি পাউডার কারখানায় কাজ করতেন। ভাই যেদিন মারা যায় সেদিন সকাল নয়টার সময় আমার সঙ্গে কথা হয়। সে তখন কাজে বের হয়। আমি ওকে বলি, ভাই যাই করো না কেন চারদিকের অবস্থা বেশি ভালো না সোজা দোকানে গিয়ে আবার সোজা বাসায় চলে এসো। আমিও মার্কেটে চাকরি করি। ও চলে আসার এক-দেড় ঘণ্টা পর আমিও মার্কেটে যাই আবার দোকান বন্ধ করে দুপুরের দিকে বাসায় চলে আসি। মার্কেটে থাকতে ঘটনার আগেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেট থেকে বের হতে চেয়েছিল। ওর সঙ্গে আরেকটি লোকও মারা যায় গুলিতে।
আলী আকবর বলেন, ভাই হারানোর যন্ত্রণা কাউকে বোঝানোর মতো না। আমাদের সবার ছোট হওয়ায় অনেক আদরের ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে মানুষ হয়েছে সেজন্য ওর প্রতি অনেক মায়া আমার। আলী হোসেনের লাশ নিয়ে অনেক ঝামেলা ছিল। মৃত্যুর তিনদিন পর অনেক জায়গা দৌড়িয়ে, অনেক ভোগান্তি পেরিয়ে আমার ভাইয়ের লাশ বুঝে পাই। পরে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। অনেকে খোঁজ-খবর নিচ্ছে। আলীর মৃত্যুতে স্ত্রী-সন্তান একদম ভেঙে পড়েছে। এদিকে বয়স্ক মা সন্তানকে হারিয়ে তিনিও ভেঙে পড়েছেন। সেই তার পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। তার সন্তানরা একেবারে ছোট। ছোটবেলা থেকে আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় পড়াশোনা করাতে পারিনি। তিনি বলেন, আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাকে হারিয়ে স্ত্রী-সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়েছে। সন্তানদের নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তা করতে থাকে। কীভাবে মানুষ করবে, কীভাবে গড়বে তাদের ভবিষ্যৎ। ওদের বাবা যে টাকা আয় করতো তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলতো। অল্প আয় থাকলেও সন্তানদের জন্য ছায়া ছিল। সব বাবা-মায়েরই তো চিন্তা থাকে সন্তানদের নিয়ে। এখন আলীর মৃত্যুতে হতাশ হয়ে পড়েছে তার স্ত্রী। সন্তানদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা করছে।