শেষের পাতা
জালিয়াতি করে এনবিআরে চাকরি, ঘুষ নেন চেকে
শরিফ রুবেল
২১ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার
মো. গোলাম নবী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের ডেসপাস রাইডার। তবে নিজেকে পরিচয় দেন এনবিআরের বড় কর্তা হিসেবে। কখনো সহকারী প্রোগ্রামার, কখনো উচ্চমান সহকারী। চড়েন ব্যক্তিগত গাড়িতে। টাকা ছাড়া কারও সঙ্গে দেখাও দেন না। ঘুষ নিয়ে একে ওকে চাকরি দেন হরহামেশাই। তবে তা প্রতারণা। নবীর মাধ্যমে কেউই চাকরি পাননি। ঘুষ লেনদেন ও প্রতারণা করে অল্প সময়ে গাড়ি, বাড়ি ও বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এলাকায় নিজেকে ঢাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে পরিচয় দেন। গ্রামে গেলেই পাড়ার লোকদের নিয়ে মিটিংয়ে বসেন। নানা বিচার সালিশ করেন। অথচ এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরাতো গোলাম নবীর। তিনি এখন বড় চাকরিজীবী। অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে চাকরির জোরে গোলাম নবী এলাকায় প্রভাব খাটান সেই চাকরির নিয়োগেই তিনি ভয়ঙ্কর জালিয়াতি করেছেন। বয়স পরিবর্তন ও জাল সনদ দিয়ে এনবিআর-এ চাকরি নিয়েছেন গোলাম নবী। ১৩ বছর ধরে এনবিআরকে বোকা বানিয়ে চাকরি করছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালে নিজেকে অষ্টম শ্রেণি পাস দেখিয়ে এনবিআরে চাকরি নেন মো. গোলাম নবী। চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজের বয়স দেখান ২৫ বছর। অথচ ২০১২ সালে নবীর শিক্ষাগত যোগ্যতার মূল সনদের প্রকৃত বয়স ছিল ৩৫ বছর ৬ মাস। চাকরির বয়স পেরিয়ে যাওয়ায় তিনি প্রতারণার আশ্রয় নেন। এসএসসি পাস হলেও সমমানের শিক্ষাগত সনদপত্র গোপন রেখে অষ্টম শ্রেণি পাস দেখিয়ে এনবিআরে চাকরি নেন।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন গোলাম নবী। যার এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন নম্বর-১০৯০৭, রোল নম্বর-২৫, শিক্ষাবর্ষ-১৯৮৯-১৯৯০। এসএসসি পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এসএসসি সনদে জন্ম ২রা জুন ১৯৭৬। এতে ২০১২ সালে চাকরি নেয়ার সময় তার বয়স হওয়ার কথা ৩৫ বছর ৬ মাস। এতে ওই সনদ অনুযায়ী তার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বসয়সীমা পার হয়ে যায়। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দেয়া একটি প্রত্যয়নপত্র থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পরে বহু বছর চাকরির পেছনে ছুটে তিনি চাকরি পাননি। এক পর্যায়ে সরকারি চাকরিও বয়স পার হয়ে যায় গোলাম নবীর। এরপর কয়েক বছর গ্রামের ক্ষেত খামারে কাজ করেছেন। চাকরির বয়স পেরোনোর ১০ বছর পরে হঠাৎ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের ডেসপাস রাইডার হিসেবে চাকরি পান। এতে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বুড়ো বয়সে কীভাবে চাকরি পেলেন তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দেয়। পরে জানা যায়, অন্যের অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেট নিয়ে এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের বয়স পাল্টে চাকরি নেন গোলাম নবী। পরিবর্তন করা জাতীয় পরিচয়পত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে গোলাম নবীর বয়স ১৫ই আগস্ট ১৯৮৩ সাল। এতে গোলাম নবীর স্ত্রী রুমা ইয়াসমিনের চেয়েও তিনি ৩ বছরের ছোট।
জাতীয় পরিচয়পত্রের বয়স সংশোধন করে প্রায় ১৫ বছর কমিয়ে ফেলেন। এ ছাড়া এনবিআরে চাকরি নিয়েও নানা প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে যান। চাকরি দেয়ার কথা বলে নিজ এলাকার একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের ঘুষ লেনদেন করেন। এমনই কয়েকটি ঘুষ লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ মানবজমিনের হাতে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালে এক প্রতিবেশীকে এনবিআরে চাকরি দেয়ার কথা বলে ৩ ধাপে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নেন গোলাম নবী। মাগুরা সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে সোনালী ব্যাংক ঢাকার কাকরাইল শাখায় গোলাম নবীর ব্যাংক হিসাবে তিন ধাপে ১২ লাখ টাকা পাঠান চাকরিপ্রত্যাশী অনুপ চক্রবর্তীর শ্বশুর পবিত্র চক্রবর্তী। যার হিসাব নম্বর- ৩৪১৩৪২৩৮। এ সময় পবিত্র চক্রবর্তী তার নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে গোলাম নবীর ব্যাংক হিসাবে এই টাকা পাঠান। তবে এরপরে ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও চাকরি দিতে পারেননি। পরে টাকা ফেরত চেয়ে গ্রাম্য সালিশ করেও কোনো সুরাহা হয়নি। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী গোলাম নবীর ঘুষ গ্রহণের তথ্য প্রমাণসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে চাপে পড়ে টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস দেন গোলাম নবী। এই মর্মে ভুক্তভোগী অনুপ চক্রবর্তীর পরিবারকে ১০ লাখ টাকার দু’টি ব্যাংক চেকও দেন। চেক নং-ঝঐ ১০-৩৭৪২৪৪৪। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সেই চেকের বিপরীতে ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা দেননি তিনি। এখানেও একের পর এক প্রতারণা করছেন। টাকা ফেরত না দিতে উল্টো ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকার একটি আদালতে চাঁদাবাজির মামলা করেন গোলাম নবী। এদিকে টাকা ফেরত না পেয়ে গোলাম নবীর বিরুদ্ধেও চেক ডিজঅনারের মামলা করে দেন অনুপ চক্রবর্তী। সিআর মামলা নং-৩৫১/২৩।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, চাকরিপ্রার্থী ব্যক্তির নাম অনুপ চক্রবর্তী। তিনি মাগুরা সদর উপজেলার সত্যপুর গ্রামের বাসিন্দা পবিত্র চক্রবর্তীর মেয়ে জামাই। পাশের বেড় আকছি গ্রামের বাসিন্দা এনবিআর কর্মচারী মো. গোলাম নবী এনএসআইয়ে চাকরি দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন।
জানতে চেয়ে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. জিয়াউল হাসান মানবজমিনকে বলেন, তিনি আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার এসএসসি পাসের সমস্ত কাগজপত্র এখনো আমাদের বিদ্যালয়ে আছে। ১৯৯৯ সালে তিনি আমাদের বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তখন তার বয়স ছিল ২৩ বছর। তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করেন।
চাকরির নামে প্রতারণার ব্যাপারে অনুপ চক্রবর্তী মানবজমিনকে বলেন, আমাকে এনএসআই’র চাকরি দেয়ার কথা ছিল। কয়েক মাস ঘুরিয়ে পরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু সে কোথাও চাকরি দিতে পারেনি। এটা ছিল একটি প্রতারণা। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। এখন টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন। গ্রামে সালিশ হলে সে ১৫ লাখ টাকার একটি চেক দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ব্যাংকে কোনো টাকা ছিল না। এটাও একটি প্রতারণা ছিল। এখন সে টাকা দিবেন না বলে হুমকি দিচ্ছেন। আমরা মামলা করেছি। মামলা চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে অভিযুক্ত মো. গোলাম নবী মানবজমিনকে বলেন, আমি অষ্টম শ্রেণি পাস করেছি। আমি কখনো এসএসসি পরীক্ষা দেইনি। আমি অষ্টম শ্রেণি পাসের সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি নিয়েছি। পরে এসএসসি পাসের প্রমাণপত্র দেখালে গোলাম নবী সত্যতা স্বীকার করে বলেন, চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। তাই বয়স কমিয়ে অষ্টম শ্রেণির সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছি। এতে আমি কারও ক্ষতি করিনি। তার থেকে স্ত্রী তিন বছরের ছোট কেন এই প্রশ্নের জবাবে নবী বলেন, এনআইডি কার্ড সংশোধনের সময় বিষয়টি খেয়াল করিনি; তাই ভুল হয়েছে। চাকরি দেয়ার কথা বলে নিজের ব্যাংক হিসাবে ১২ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এই বিষয়ে একটি সালিশ হয়েছে। আমি তাদের টাকা ফেরত দিতে চেয়েছি। তাদের একটি চেকও দিয়েছি। তারা আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এখন আদালতের বিষয়; এটা আদালতের মাধ্যমেই সমাধান হবে।
পাঠকের মতামত
Pls. show Golam Nobi Picture.
যথাযথভাবে অনুসন্ধান করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে। আমার জানা মতে, এনবিআরে উচ্চ পদস্ত আরো বহু ব্যক্তি আছে, অর্থের বিনিময়ে চাকরি হয়েছে।