ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৩০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

বাংলারজমিন

পিতার শহরে পুত্রের স্বপ্ন, অতঃপর...

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবারmzamin

৩০-৩৫ বছরের টগবগে যুবক। তারুণ্যের সবটুকু দিয়ে দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের মহাপরিকল্পনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তালিকা অনুযায়ী, একে একে স্বপ্নগুলো দৃশ্যমান করার ছক নিজের মধ্যে পুষে রেখেছেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় তার গোপন ভাবনাগুলো শেয়ার করতেন। পিতার জন্মভূমিকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করতে আলাদা ভালোবাসা বাসা বাঁধে তার বুকে। নিদ্রাহীন স্বপ্ন চোখ জুড়ে। বাস্তবায়নের অবাধ সুযোগ আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন কাজে। স্বপ্নবাজ সেই তরুণ আরাফাত রহমান কোকো। ২০০২-০৩ সালের কথা। মা বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। দেশকে এগিয়ে নেয়ার হ্যান্ডেল তখন মায়ের হাতে। বড় ভাই তারেক রহমান মায়ের পাশে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান। সময় দেন। পরিশ্রম করেন। কোকোর স্বপ্ন খেলার জগতকে এগিয়ে নেয়া।
উত্তরের গেটওয়ে বগুড়া। কোকোর স্বপ্নের শহর। ভালোবাসার শহর। পিতা শহীদ জিয়াউর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত শহর। এই শহরের অলিগলিতে তার পিতার পায়ের ছাপ লেগে আছে। এই অঞ্চলের আপামর মানুষের হৃদয় কোঠরে বসার আসন ছিল মহান মানুষটির। এত ভালোবাসা কোনো মানুষ মানুষের কাছে পেতে পারে জিয়াউর রহমান তার অন্যতম উদাহরণ। কোকোর দৃষ্টি জুড়ে কেবল পিতার সেই শহর। নিজে তরুণ। সঙ্গত কারণেই তরুণদের নিয়ে বেশি ভাবনা ছিল তার। বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেয়া।  বগুড়া শহরের খান্দারে অবস্থিত শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের মূল্য গেইটে প্রবেশ করে ডান দিকে তাকালেই চোখে পড়ে মার্বেল পাথরে খোদাই করা নেম প্লেট। শহীদ চাঁন্দু ক্রীড়া কমপ্লেক্স। ফলকটি ২০০৩ সালের ৩রা জুন উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বগুড়াকে ক্রীড়াঙ্গনের ‘সেকেন্ডহোম’ বানাতে চেয়েছিলেন আরাফাত রহমান কোকো। এই ক্রীড়া কমপ্লেক্সটি ছিল সেই স্বপ্ন পূরণের মূল সূতিকাগার। তৎকালীন সরকারে থাকা বগুড়ার উন্নয়নবিরোধী একটি গ্রুপের বাধার কারণে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি কোকো। এরপর কেটে গেছে প্রায় দুই যুগ। মার্বেল পাথরের সেই ফলক এখনো জ্বলজ্বল করলেও ক্রীড়া কমপ্লেক্সের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করেনি।
আরাফাত রহমান কোকো মাঝে মধ্যেই বগুড়ায় আসতেন। ক্রীড়া কমপ্লেক্স করবেন। ক্রিকেটকে এগিয়ে নেয়ার কাজ করবেন। কোকো বগুড়াকে উত্তরাঞ্চলে ক্রীড়ার রাজধানী করতে চেয়েছিলেন। বগুড়া থেকেই জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়ার তৈরির ইচ্ছে ছিল তার। এ লক্ষ্যে ২০০২ সালে শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের আধুনিকায়ন করা হয়। পরবর্তীতে আইসিসি এই স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদা দেয়। পরে ওয়ান ডে এবং টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করা হয় ওই স্টেডিয়ামে। তার হাত ধরেই ২০০৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয় এই মাঠে। শুধু স্টেডিয়াম নয়, ওই স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে আধুনিক ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন কোকো। শুধু ক্রিকেট নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন এক জায়গায় করতে চেয়েছিলেন। তার ক্রীড়া কমপ্লেক্সের পরিকল্পনায় ছিল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে একটি আধুনিক ফুটবল স্টেডিয়াম, আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন জিম, সর্বাধুনিক সুইমিং পুল, অ্যাথলেটিকসের জন্য আলাদা মাঠ, ভলিবল মাঠ, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড এবং শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের ফাঁকা জায়গায় আবাসিক হোটেল। স্টেডিয়ামের পাশের কৃষি খামারের কিছু অংশ নিয়ে সেখানে ফুটবল স্টেডিয়াম এবং অ্যাথলেটিকসের জন্য ট্র্যাক নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি মহল বিরোধিতা করায় সেটা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
আরাফাত রহমান কোকো শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে আলাদা একটি ক্রীড়া জগৎ গড়তে চেয়েছিলেন। ওভার ব্রিজের মাধ্যমে এক স্টেডিয়াম থেকে আরেক স্টেডিয়ামে এবং সুইমিং পুলে সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন খেলোয়াড়দের নিজস্ব আবাসিক হোটেল তৈরি করতে। যেখানে থেকে খেলোয়াড়রা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে পারতেন। তিনি বগুড়ায় একটি আধুনিক ক্রিকেট একাডেমিও করতে চেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার তৈরির জন্য শ্রীলংকান কিউরেটর নন্দসেনাকে দিয়ে স্টেডিয়ামে দু’টি বাউন্সি উইকেট তৈরি করেছিলেন। যা দেশের অন্য কোনো ভেন্যুতে ছিল না। সেই বাউন্সি উইকেটে অনুশীলন করেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এখনো সেই উইকেটগুলো দেশের সেরা বাউন্সি উইকেট হিসেবে বিবেচিত।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ক্রিকেট এবং ফুটবলে উত্তরাঞ্চলে প্রচুর সম্ভাবনা আগে থেকেই রয়েছে। আরাফাত রহমান কোকোর পরিকল্পনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে বগুড়া থেকে জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় সরবরাহ করা যেতো। বিশেষ করে একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরি হলে এই অঞ্চলের ক্রীড়ায় ব্যাপক উন্নয়ন করা সম্ভব হতো।
ক্রীড়া সাংবাদিক মোস্তফা মোঘল বলেন, রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গেই বদলে গেছে বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনের চেহারা। অতীতের সব সাফল্য, অবদান ভুলে গেছেন কর্তারা। যেই নির্লোভ মানুষটি শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামকে সারা দুনিয়ায় পরিচিত করে তুলেছিলেন, সেই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর দিনেও তাকে স্মরণ করে না কেউ। শুধু তাই নয়, একসময় যারা শহীদ জিয়ার নামে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাও কখনো এই দিনটি স্মরণ করে না। রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন সুবিধাভোগী ক্রীড়া সংগঠকরা। ফলে একজন কীর্তিমান ক্রমেই স্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছেন। মুছে ফেলা হচ্ছে তার পরিকল্পনাগুলোকেও। নতুন প্রজন্ম জানার সুযোগই পাচ্ছে না মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর অবদানগুলো।
কোকো ২০০২-২০০৫ সনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এই সময় বিসিবি’র গেমস ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন। এ ছাড়া ক্রীড়াসংঘ ওল্ড ডিওএইচ’র চেয়ারম্যান ছিলেন। যুক্ত ছিলেন সিটি ক্লাবের সঙ্গে। শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম মিরপুর ও বগুড়া শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের রূপকার তিনি।

 

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status