× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

রোগীর মৃত্যু ও চিকিৎসকের কান্না

অনলাইন

জহিরুল ইসলাম জহির, লালমাই (কুমিল্লা) থেকে
(২ বছর আগে) আগস্ট ১, ২০২১, রবিবার, ৭:২৯ অপরাহ্ন

সোহেল আহমেদ (৩০)। বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ঝলম ইউনিয়নের ওড্ডা গ্রামে। কাতারে ছিলেন দীর্ঘ ৭ বছর। গত ৫ মাস পূর্বে দেশে চলে আসেন। করোনাকালে কোন কাজ না পেয়ে কয়েক মাস ধরে রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। ঈদ উল আযহার দু’দিন আগে হঠাৎ জ্বর ও কাঁশি শুরু হয় তার। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যেতে থাকে। ঈদের পর কুমিল্লা পিপলস হাসপাতালে এক্স-রেসহ কয়েকটি পরীক্ষা করান।
রিপোর্ট দেখে চিকিসৎকরা করোনা হয়েছে বলে কিছু ওষুধ লিখে দেন। কিন্তু ওষুধে কোন কাজ হচ্ছিল না।

এরপর একজন পল্লী চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ভর্তি করা হয় কুমিল্লা জাঙ্গালিয়াস্থ ন্যাশনাল হাসপাতালে। এক সপ্তাহ পর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৩৭-এ নেমে আসায় গত ৩১শে জুলাই দুপুরে সেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে। আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় ন্যাশনাল হাসপাতালের বিল ৩৪ হাজার টাকা পরিশোধ করতে পারলেও ঢাকায় নেয়ার মতো তাদের হাতে আর কোন নগদ টাকা ছিল না। তাই তারা শনিবার বিকালে সোহেলকে লালমাই উপজেলার বাগমারা ২০ শয্যা হাসপাতালে নেন। লালমাই উপজেলার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও হাসপাতালের আরএমও ডা. আনোয়ার উল্যাহ রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখে ভর্তি না নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু কুমেক-এ সিট খালি না থাকায় বাগমারা হাসপাতালেই রোগীর ভর্তির ব্যবস্থা করতে চিকিৎসকদের অনুরোধ করেন সোহেলের মা ফিরোজা বেগম ও স্ত্রী খাদিজা আক্তার। এরপর আরএমও’র সম্মতিতে সোহেলকে ভর্তি করে করোনা ইউনিটের ৭নং বেডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেবা প্রদান শুরু করা হয়।

এদিকে, ৫টি খালি সিলিন্ডার (৭.৫ কিউবিক মিটার) রিফিল করে বিকাল ৫টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছার কথা থাকলেও পৌঁছেনি। সন্ধ্যা ৭টায় হাসপাতালের অবশিষ্ট সেন্ট্রাল অক্সিজেনও শেষ হয়ে যায়। তখন সোহেলকে হাসপাতালের রিজার্ভে থাকা ২টি সিলিন্ডার (২ কিউবিক মিটার) দিয়ে অক্সিজেন সেবা অব্যাহত রাখা হয়। রাত ১২টার পর ওই ২টি সিলিন্ডারও শেষ হয়ে যায়। ততক্ষণেও রিফিল সিলিন্ডারগুলো হাসপাতালে পৌঁছেনি। ওই সময় আরএমও-এর অনুরোধে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্য দু’জন রোগীর অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে সোহেলকে অক্সিজেন দেয়া হয়। এরই মধ্যে রিফিল সিলিন্ডার নিয়ে হাসপাতালমুখী স্পেক্ট্রা কোম্পানীর গাড়ি চালককে বারবার ফোন করা হয়- দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে। কিন্তু রিফিল করতে বিলম্ব হওয়ায় গাড়ি চালক দুঃখ প্রকাশ করে জানান, বাগমারা পৌঁছতে তার অনুমান সকাল ৬টা বাজবে। একই সময়ে আরএমও লালমাই উপজেলার সবকয়টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দায়িত্বশীলদের অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য ফোন করেন। কিন্তু ওই সময় কোন সংগঠনের হাতে রিজার্ভ সিলিন্ডার ছিল না। রাত অনুমান ৩টা ৪৫মিনিটে হাসপাতালে থাকা সব সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। এরপর আধাঘণ্টা তাকে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর মেশিন দিয়েও শ্বাস দেয়া হয়। একপর্যায়ে মেশিনেও তাকে অক্সিজেন সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অক্সিজেন নিতে না পেরে সোহেল ছটফট করেন। চোখের সামনে অক্সিজেনের জন্য রোগীর মৃত্যু যন্ত্রণা দেখে আরএমওসহ রোগীর স্বজন, অন্যরোগী ও তাদের স্বজনরা কান্না শুরু করেন। ভোর রাত অনুমান ৪টায় সোহেল আহমেদ মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি মা, বাবা, স্ত্রী, নুসিফা (৮) ও রুইজা (৪) নামে দুই কন্যা সন্তান রেখে গেছেন।

করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রবিউল আলম বলেন, আরএমও স্যার এই রোগীর জন্য অক্সিজেন সংগ্রহ করতে অনেকজনকে ফোন করেছেন। সারারাত স্যার করোনা ইউনিটে ছিলেন। রিফিলের গাড়ি সময়মত পৌঁছলে হয়তো রোগীর মৃত্যু হতো না। মৃত্যুর পর নিজ চেম্বারে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে বসে আরএমও স্যার প্রায় আধাঘণ্টা কান্না করেছেন।

রোগীর স্ত্রী খাদিজা আক্তার জুলি বলেন, বাগমারা হাসপাতালের চিকিৎসকরা আমার স্বামীকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪টি সিলিন্ডার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে আমরা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম কে হারিয়েছি।

বাগমারা হাসপাতালের আরএমও ডা. আনোয়ার উল্যাহ বলেন, অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু সহ্য করতে কষ্ট হয়েছিল। রাতে অক্সিজেন সংগ্রহের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর দায়িত্বশীলদেরও ফোন করেছি। অবশ্য রোগীর মৃত্যুর একঘণ্টা পর রিফিল সিলিন্ডারের গাড়ি হাসপাতালে পৌঁছেছে।

উল্লেখ্য, বাগমারা ২০ শয্যা হাসপাতালটিতে এখনও সরকারিভাবে ইনডোর স্বাস্থ্যসেবা চালু করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুধুমাত্র আউটডোর সেবা চালু রাখার নির্দেশনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে কোন ধরনের সরকারি অর্থ বরাদ্দও আসেনি। তারপরও অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল এমপির ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও আবুল খায়ের কোম্পানীর সহযোগিতায় গত ২৫শে এপ্রিল এই হাসপাতালটিতে ২টি আইসিইউ শয্যাসহ মোট ১২টি অক্সিজেন শয্যা স্থাপন করা হয়। সেন্ট্রাল অক্সিজেনের আওতায় জরুরি বিভাগেও দুটি অক্সিজেন শয্যা সেট করা হয়। সেই সময় আবুল খায়ের কোম্পানী থেকে সাড়ে ৭ হাজার লিটারের মোট ১২টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দেয়া হয়। ১লা আগষ্ট সকাল পর্যন্ত এই হাসপাতালে ১০ জন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন।







অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর