প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক, জ্ঞান ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রগতিশীল সমাজ গঠনের লক্ষ্যে দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতার আদর্শে তরুণ প্রজন্মকে প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ব্যাপারে যুবলীগকে অগ্রণী ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রস্তুত করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী গতকাল বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। গণভবন থেকে তিনি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে (কেআইবি) আয়োজিত আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ’র সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক যুব নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক বক্তৃতা করেন। সাবেক যুবলীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আযম এমপি এবং হারুনুর রশিদ বক্তৃতা করেন। যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মইনুল হোসেন খান নিখিল সভা সঞ্চালনা করেন।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানিয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের ভিডিও বার্তাও প্রচার করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, ডিবিসি নিউজ এর প্রধান সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল ইসলাম, দৈনিক সমকাল পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি এবং বিশিষ্ট বাউল শিল্পী শফি মণ্ডল। খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি নেতাদের দাবির প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বাড়িতে থাকার অনুমতি দিয়ে এবং দেশের সর্বোত্তম চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দিয়ে তারা সর্বোচ্চ সহানুভূতি দেখিয়েছেন। অন্যদিকে এতিমের টাকা আত্মসাৎ করে দোষী সাব্যস্ত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার পাশাপাশি কেবল প্রতিহিংসার বশবর্তী ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার দিনে জন্মদিন না হওয়া সত্ত্বেও কেবল কষ্ট দেয়ার জন্য জন্মদিন পালনের মতো অমানবিক অপরাধের অভিযোগও রয়েছে। তিনি বিএনপি নেতাদের প্রশ্ন করেন, তারা আমাদের কাছে কি আশা করছে? আমরা তাকে বাড়িতে থাকতে এবং দেশের সেরা হাসপাতালে অবাধে চিকিৎসা নিতে দিয়েছি। এটা কি যথেষ্ট নয়? এটা কি বিরাট উদারতা নয়? আমরা এটা (উদারতা) দেখিয়েছি। তার ছেলে তারেকের বউ ডাক্তার। শুনেছি সে নাকি অনলাইনে শাশুড়িকে দেখে। কই ছেলে, ছেলের বউ তো কোনো দিন দেখতে এলো না। অবশ্য কোকোর বউ এসেছে। তারা তো আসে নাই। যাই হোক তবু বিএনপি এতদিন পর একটা সুযোগ পেয়েছে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার এই দাবিতে তারা আন্দোলন করছে। খুব ভালো তারা আন্দোলন করুক। কিন্তু আমার যতটুকু করার ছিল সেটা কিন্তু আমি করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, এরশাদকে তো কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল। তাকে চিকিৎসার জন্য কোনো দিনও সুযোগ করে দেয়নি। রওশন এরশাদকে দেয়নি। আবার জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায়, আমাদের সাজেদা চৌধুরীর অপারেশন হয়েছিল। ঘা শুকায়নি। সেই ব্যান্ডেজ অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করে জিয়াউর রহমান জেলে ভরেছিল। ঠিক একই অবস্থা মতিয়া চৌধুরীর, তাকেও তখন জেলে দিয়েছিল। তারও তখন টিবি হয়েছিল, অসুস্থ ছিল। তাকেও জেলে দিয়েছিল। এরকম বহু অন্যায়-অবিচারের কথা আছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমি বিএনপির নেতাদের জিজ্ঞাসা করি- তারা যে সহানুভূতি দেখাতে বলে, তারা যে সহযোগিতা চায়- খালেদা জিয়া কেমন আচরণ করেছিল? একুশে আগস্ট যে গ্রেনেড হামলা তার আগে খালেদা জিয়ার কি বক্তব্য ছিল? শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা কোনো দিন বিরোধী দলের নেতাও হতে পারবে না- এই বক্তৃতাই তো খালেদা জিয়া দিয়েছিল এবং আওয়ামী লীগ একশ’ বছরেও ক্ষমতায় যেতে পারবে না। আল্লাহর খেলা বোঝা তো ভার। বরং খালেদা জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হতে পারেনি, বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারেনি। এটা তার ওপরেই ফলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারপরও সে যখন অসুস্থ এবং দুর্নীতির দায়ে দোষী- সে দুর্নীতিটা কি? গ্যাটকোর কেস তার বিরুদ্ধে, নাইকোর কেস তার বিরুদ্ধে এবং এটা কিন্তু আমাদের না। আমেরিকার এফবিআই তারা খুঁজে বের করেছে। সিঙ্গাপুরে তার এবং তার ছেলের দুর্নীতি বেরিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাই বের করেছে। সেই কেসগুলো তো আছেই। সবচেয়ে বড় কথা এতিমদের জন্য টাকা এসেছিল। সেই এতিমদের টাকা এতিমের হাতে কোনো দিন পৌঁছায় নাই। সে টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে রেখে দিয়েছে। তিনি বলেন, নিজেই খেয়েছে সে টাকা, খালেদা জিয়াই ভোগ করেছে এতিমের অর্থ। কাজেই সেই সাজা পেয়েছে এবং সেই সাজা সে ভোগ করছে। তারপর সে কারাগারে ছিল। খালেদা জিয়ার বড় বোন আর ভাই আমার কাছে এসেছে। বোন, বোনের স্বামী, ভাই এরা সব এসেছিল। এলো যখন খুব স্বাভাবিকভাবে রেহানাও আমার সঙ্গে উপস্থিত ছিল। একটা মানবিক দিক থেকে আমি তাকে তার বাড়িতে থাকার একটা ব্যবস্থা- আমার এক্সিকিউটিভ পাওয়ারে আমি যতটুকু করতে পারি অর্থাৎ নির্বাহী যে ক্ষমতাটা আমার আছে সেটার মাধ্যমে আমি তার সাজাটা স্থগিত করে বাসায় থাকার অনুমতি এবং চিকিৎসার অনুমতি দিয়েছি। সরকার প্রধান বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে দেশের কি অবস্থা ছিল? আজকে তার চিকিৎসার জন্য এত চেঁচামেচি করে বেড়াচ্ছে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান যখন অসুস্থ তাকে সিএমএইচে চিকিৎসা পর্যন্ত করতে দেয় নাই, এমন কি সে যখন আইসিইউতে ভর্তি তাকে স্ট্রেচারে করে কোর্টে নিয়ে হাজির করেছে। তাকে জেনারেল পদ দেয়া হয়েছিল সেটা বাতিল করে দিয়েছিল। তার প্রমোশনও বাতিল করেছিল। তিনি বলেন, আমি সেনাবাহিনীতে নারী অফিসারদের ভর্তি নিশ্চিত করি। কারণ, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে আগে নারী সদস্য ছিল না। আমি তাদের নিই। মোস্তাফিজের ছোট মেয়ে সে প্রথম ব্যাচে জয়েন করে। তার পাসিং আউট প্যারেড যখন হয় খালেদা জিয়া ক্ষমতায়। আমি একটা নিয়ম করেছিলাম সেটা এখনও চলমান- বাবা-মা তাদের প্যারেডে উপস্থিত থাকবে। তারা নিজের হাতে তার সন্তানকে ব্যাজ পরাবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, খালেদা জিয়া জেনারেল মোস্তাফিজ ও তার স্ত্রীকে আসতে দেয়নি। তার মেয়ের ব্যাজটা তারা পরাতে পারেনি। অথচ এরাই ছিল সেনাবাহিনীতে প্রথম নারী অফিসার। কিন্তু মোস্তাফিজের সেই পারমিশনটা পর্যন্ত ছিল না-এই হলো খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আমাদের পার্টির অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করে যে অকথ্য অত্যাচার করেছে- বাহাউদ্দিন নাছিম থেকে শুরু করে মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবের হোসেন, শেখ সেলিমসহ বহু নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করেছে। নাসিমকে তো এমন অত্যাচার করেছিল যে তাকে মৃত মনে করে তাড়াতাড়ি কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সে বেঁচে গেছে। দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে- আবার সেই অত্যাচারের ভিডিও নিয়ে খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া দেখে উৎফুল্ল হয়েছে। এই ধরনের হিংস্র একটা চরিত্র আমরা দেখেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু তাই না, খালেদা জিয়ার ছেলে কোকো যখন মারা গেল- আমি গেলাম সহানুভূতি দেখাতে। আমি হঠাৎ করে যাইনি। আমার এখান থেকে আমার মিলিটারি সেক্রেটারি যোগাযোগ করেছে। এডিসি যোগাযোগ করেছে। সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আমি সময় মতো গেছি। আমার এখান থেকে এসএসএফ গেছে, সেখানে তারা দেখেছে কোথায় যাবো। আমি যখন রওনা হয়ে গেছি, গুলশান রোডে ঢুকছি তখন শুনলাম ওই বাড়ির মেইন গেট খুলবে না, আমার গাড়ি ঢুকতে দেবে না। তা আমি বললাম- এতদূর যখন চলে আসছি ফিরে আসবো কেন? পাশে নিশ্চয়ই পকেট গেট আছে, সেখান দিয়ে যাবো। যখনই আমার গাড়িটা বাড়ির সামনে থেমেছে আমার যে এসএসএফ অফিসারটা ভেতরে ছিল- সে আমাকে ভেতরে নিতে জাস্ট বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে তালা দিয়ে দেয় তারা। আমি গাড়ি থেকে নেমে বেকুব হয়ে গেলাম, আমি আর ঢুকতে পারি না। আমি গেছি একটা সন্তানহারা মাকে সহানুভূতি দেখাতে। আর সেখানে এভাবে অপমান করে ফেরত দিয়েছে আমাকে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে একটা ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিল। কারণ, তার ইচ্ছা ছিল কোনোমতো জনগণের ভোটটা চুরি করে সে ক্ষমতায় টিকে থাকবে। কিন্তু চুরি করা সম্পদ যে ধরে রাখা যায় না, জনগণের ভোট চুরি করলে আর ক্ষমতায় থাকা যায় না- সেটা সে বুঝতে পারেনি। ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কর্নেল রশীদ এবং মেজর হুদা একজনকে কুমিল্লা থেকে আরেকজনকে চুয়াডাঙ্গা থেকে সেই ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত ঘোষণা করে পার্লামেন্টে এনে বসায়। আর জিয়াউর রহমান যেমন ওই রাজাকার-আলবদর বাহিনী এবং যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে তাদের মন্ত্রী, উপদেষ্টা করেছিল, খালেদা জিয়াও সেই একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে- সেই যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানায় এবং ক্ষমতায় বসায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ই ফেব্রুয়ারির সেই ভোট চুরির নির্বাচন খালেদা জিয়া টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ভোট চুরির অপরাধে এই বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলন গড়ে তোলে এবং খালেদা জিয়া বাধ্য হয় ৩০শে মার্চ ’৯৬ সালে পদত্যাগ করতে। গণ-আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেছিল- এটা বোধহয় দেশবাসীর মনে রাখা উচিত। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভোট চুরি করে নির্বাচিত ঘোষণা করেছে নিজেকে। তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। আর ঠিক তার দেড় মাসের মধ্যে তাকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রতিটি অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুবসমাজ সবসময় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। সেজন্য ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারটা যুবসমাজকে উৎসর্গ করেই তৈরি হয়েছে- ‘তারুণ্যের উন্নতি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করার জন্য তারুণ্যের শক্তিটাকেই আমরা গুরুত্ব দিয়েছি এবং তরুণ সমাজকে আমরা তৈরি করতে চেয়েছি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। শিক্ষায়-দীক্ষায় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। যাতে করে এই তরুণ সমাজই আগামী দিনে এগিয়ে যেতে পারে। তিনি যুবলীগ চেয়ারম্যানের বক্তব্যের রেশ ধরে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অসামপ্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তোলা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক প্রগতিশীল ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের মতো বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে যদি যুবলীগ গড়ে উঠতে পারে তাহলে এদেশের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। আর আমরা যে আর্থ-সামাজিক উন্নতি করেছি, সে মতেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশের পথে যাবার পরিকল্পনা রূপকল্প ২০৪১ তার সরকার করে দিয়েছে। সেটা ধরে এগিয়ে গেলে পরে বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীনতার সুফল বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছাবে এবং প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন পাবে- সেটাই আমরা চাই।