শিক্ষাঙ্গন
নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয়েই অরক্ষিত নজরুলের স্মৃতিচিহ্ন
কামরুল হাসান, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
(১ দিন আগে) ২৪ মে ২০২৫, শনিবার, ৫:৪০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৫:৪৪ অপরাহ্ন

ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থানকালীন সময়ে কিশোর নজরুল যে বটবৃক্ষের নিচে বসে বাঁশি বাজাতেন, সেই বৃক্ষটিকে কেন্দ্র করে শুকনি বিলের পাশে নজরুলের নামে গড়ে ওঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। এটাই নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। যে বৃক্ষটিকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলো, সীমানা প্রাচীর নির্মাণের নামে সেই বটবৃক্ষটিকেই আড়াল করে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কবির স্মৃতিবিজড়িত সেই বটবৃক্ষটি বিশ্ববিদ্যালয় সীমানাপ্রাচীরের বাইরে এখন পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়।
১১০ বছর আগে ময়মনসিংহের ত্রিশালে এসেছিলেন কিশোর দুখু মিয়া। দুখু মিয়ার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে দারোগা রফিজউল্লাহ তাকে ভর্তি করান দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কুলে (বর্তমান নজরুল একাডেমি)। প্রথমে কাজীর শিমলা দারোগা বাড়িতে থাকলেও যাতায়াতের কষ্ট লাঘবের জন্য দারোগা সাহেব দুখু মিয়াকে ত্রিশালের নামাপাড়ায় জায়গীর রাখেন। স্বাধীনচেতা নজরুল মাঝে মধ্যে স্কুল বাদ দিয়ে নামাপাড়া শুকনি বিলের পাশে বটবৃক্ষে চড়ে বাঁশি বাজাতেন। যে বটগাছে বসে দুখু মিয়া বাঁশি বাজাতেন সেই গাছটিই এখন নজরুল বটবৃক্ষ নামে পরিচিত।
কবির স্মৃতি ধরে রাখতে সেই বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করেই নজরুলপ্রেমীরা দাবি করেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। সেই বটগাছের পাশেই শুকনি বিলে ৯৩ বছর পর ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা পায় কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়। কবি নেই, কিন্তু বটগাছটি আজও কালের সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৫ সালের ১ মার্চ কবির সেই স্মৃতিবিজড়িত বটতলার পাশেই ১৫ একর জমি নিয়ে যাত্রা শুরু করা জাতীয় কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। শুরুতে বটবৃক্ষের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থাকলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার করা ভিত্তিপ্রস্তর এবং কবির স্মৃতিবিজড়িত বটবৃক্ষটিকে ধীরে ধীরে আড়াল করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর এবং বটগাছটিকে বাদ দিয়েই সীমানাপ্রচীর নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে নজরুলের স্মৃতিধন্য বৃক্ষটি ক্যাম্পাসের বাইরে ও ভবনের আড়ালে পড়ে যায়। এ গাছের নিচে এখন চায়ের দোকান আর টং দোকানের বাহারি সমাহার, নেই কোনো পরিচর্যা। কবি এই স্মৃতিবিজড়িত স্থানটি এখন পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। যে বটগাছকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরুলের স্মৃতি সংরক্ষণে এমন উদাসীনতায় ক্ষুব্ধ নজরুল প্রেমীরা।
অনেকে মনে করছেন বটতলার পাশেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার করা ভিত্তিপ্রস্তরের কারণেই বিগত প্রশাসন এতদিন এই বটগাছটিকে সীমানা প্রাচীরের বাইরে রেখেছে। এমতাবস্থায় বটগাছটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণের তাগিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী ও নজরুল প্রেমীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কৌশিক আহমেদ শোভন বলেন, ‘যে বটগাছকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হলেও বটগাছটি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটি জাতীয় কবির স্মৃতিকে অবমাননার সমতুল্য। কবির স্মৃতিবিজড়িত বটগাছটিকে সংরক্ষণ করা জরুরি। ’
নজরুল গবেষক এবং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজের উপ-পরিচালক রাশেদুল আনাম বলেন, ‘কালের পরিক্রমায় নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত সব জায়গার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংস্কার হলেও একমাত্র জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে বটগাছটি। যেহেতু নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত বটগাছটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ডা. মো. মাহবুবুর রহমান লিটন বলেন, ‘বিগত ফ্যাসিবাদী প্রশাসন অত্যন্ত সুকৌশলে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্বোধনকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর এবং কবি নজরুলের স্মৃতি চিহ্ন বটগাছটিকে বাইরে রেখেই সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করেছে। ভিত্তিপ্রস্তরটি সংস্কার শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ওয়ার্কস কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সামনে যখন জমি অধিগ্রহণ করা হবে তখন বটগাছটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নেয়া হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বটতলার জায়গাটি ব্যক্তিমালিকানাধীন। আমরা বটগাছটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আশা রাখি দ্রুত সময়ের মধ্যে কবি নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত বটগাছটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।’