অনলাইন
রাষ্ট্রতো মিষ্টির দোকান নয়
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
(১ দিন আগে) ৩০ জুন ২০২৫, সোমবার, ৯:৩৪ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০১ পূর্বাহ্ন

রাষ্ট্র তো আর মিষ্টির দোকান নয়—যেখানে একটা ‘আদি মরণ চাঁদ’, পাশেই ‘নিউ মরণ চাঁদ” নামকরণ করা যাবে। মুদি দোকান বা মিষ্টির দোকানের মতো নামকরণ রাষ্ট্রের বেলায় প্রযোজ্য হবে না। ‘আদি বাংলাদেশ’ কিংবা ‘নতুন বাংলাদেশ’ নামে রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করা যাবে না। রাষ্ট্র অখণ্ড-অবিভাজ্য।
রাষ্ট্রের নাম থাকবে একটাই—যে নামে গাঁথা আছে তার জনগণের আত্মপরিচয়, ইতিহাস, সংগ্রাম ও চেতনা।
জনগণের অনুভূতি ও ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকার ৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ উদযাপন থেকে সরে এসেছে—এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। এছাড়া ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ এবং ১৬ জুলাইকে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে।
রোববার (২৯ জুন) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রাষ্ট্র হলো মানুষের ঐতিহাসিক-সংগ্রামের, আত্মদানের নৈতিক ও সামষ্টিক চেতনার নাম। রাষ্ট্রের নাম, পরিচয় ও কাঠামো কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ফ্যান্টাসি বা হঠাৎ পাওয়া ক্ষমতার মোহে গঠিত হয় না—তা গড়ে ওঠে লক্ষ মানুষের রক্ত, ভাষা, সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক সম্মতির ভিতের উপর।
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কিছু গোষ্ঠী বা কোনো একটি পক্ষ রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। সুতরাং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ বিষয়টা পর্যালোচনা জরুরি।
'বাংলাদেশ’ নামটি কেবল একটি ভূখণ্ডের পরিচয় নয়, এটি আত্মদান ও সংগ্রামের স্মারক। এখানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আছে, ভাষা আন্দোলন আছে, আছে আত্মবোধের জাগরণ। এই নাম পরিবর্তনের যেকোনো উদ্যোগ—সেই ইতিহাসের প্রতি অবমাননা, শহিদদের স্মৃতির প্রতি অসম্মান।
আজ যখন রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের গুঞ্জন শোনা যায়, তখন প্রশ্ন জাগে—এই রাষ্ট্র কি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো কোম্পানি? যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাল্টে ফেলা যায় মনগড়াভাবে! এই প্রশ্ন শুধু আবেগের নয়, গভীর-নৈতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রকে যদি আমরা রাজনৈতিক সম্প্রদায় বা জনগণের সম্মিলিত নৈতিক কাঠামো হিসেবে ধরি, তবে সেই কাঠামোর নাম ও পরিচিতি পরিবর্তন করতে হলে চাই— জনগণের সম্মতি, সাংবিধানিক বিতর্ক এবং ইতিহাসের সঙ্গে সদর্থক বোঝাপড়া।
রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া হলো জনগণের একটি চুক্তিভিত্তিক এবং নৈতিক সংহতির ফল। এই চুক্তি ভাঙা যায় না হঠাৎ ইচ্ছায়, আর সংহতি ধ্বংস করা যায় না কারও একক চেতনায়। রাষ্ট্র মানে জনগণের ইতিহাস, জাতিসত্তার বিকাশ, ভাষার অধিকার এবং গণতন্ত্রের স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে বিকৃত করার অধিকার কারও নেই।
এ কারণেই বলতে হয়—রাষ্ট্র তো মিষ্টির দোকান নয়।
একটি রাষ্ট্রের নাম শুধুই শব্দ নয়; এটি একটি জাতির নৈতিক অবস্থান, ঐতিহাসিক স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের দায়বদ্ধতার প্রতীক। 'বাংলাদেশ' নামটি এসেছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত ভূমি থেকে—এ নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের অভিপ্রায়।
রাষ্ট্র গঠনে ‘নতুন বাংলাদেশ’ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ‘সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ ‘সোনার বাংলাদেশ’ নির্মাণের রাজনৈতিক অভিপ্রায় থাকবে, কিন্তু তা রাষ্ট্রের নামে অনুপ্রবেশ করবে না। জনগণ রাষ্ট্রের ক্রেতা নয়, মালিক।
রাষ্ট্র কোনো ব্র্যান্ড নয়, রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণের আস্থার প্রতিষ্ঠান—যেখানে নাম পাল্টে নয়, মানসিকতা পাল্টে উন্নতি বা পরিবর্তন আনতে হয়। যদি কিছু বদলাতে হয়—তা হবে ন্যায়বিচারের কাঠামো, অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার।
রাষ্ট্রের নাম একটি শপথ—যা শহীদদের রক্তে লেখা, জনগণের কণ্ঠে উচ্চারিত এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া যায় একটি উত্তরাধিকার হিসেবে। সেই শপথে যেনো আমরা অটল থাকি।
রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন মানে কেবল শব্দ বদল নয়; এটি ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা। যারা রাষ্ট্রের নাম বদলাতে চায়, তাদের প্রশ্ন করতে হবে—তারা কি ইতিহাসে নিজের নাম চিহ্নিত করতে চাইছে, নাকি পূর্বতন রক্তক্ষয়ী ইতিহাস মুছে দিয়ে এক প্রকার ঐতিহ্যহীন নতুন মালিকানা কায়েম করতে চাইছে?
রাষ্ট্রের নাম বদল কেবল একটি প্রতীকী পরিবর্তন নয়, এটি জাতির ইতিহাস ও চেতনার উপর সরাসরি আঘাত। যদি এটা একতরফা হয়, তবে তা নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতা। রাষ্ট্র কোনো মিষ্টির দোকান নয়, যার নাম পাল্টে দেওয়া যায় দোকানদারের ইচ্ছায়। রাষ্ট্রের নাম হলো—একটি জাতির যৌথনৈতিক ঐতিহ্য,—তাকে রক্ষা করা নাগরিক-সমাজ ও রাষ্ট্রে—উভয়ের দায়িত্ব।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠকের মতামত
I don't know who raised this issue and why, changing the name of the country. But even then I should say its not new or first-time in the world. Of course that is possible if majority of the people desire that. Thanks.
সত্যি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপন এবং সময়োপযোগী চমৎকার বিশ্লেষণ। আশা করি সবার হৃদয়ে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হবে এবং মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত হবে।
"ডিজিটাল বাংলাদেশ", "স্মার্ট বাংলাদেশ" এগুলাতে কোন সমস্যা হয় নাই। "নতুন বাংলাদেশ" শুনলেই গাত্রোদহো হয়। এই গুলা হলো মুনাফেক ।
বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ হাজার বছরের বাংলা। নাম পরিবর্তনের কোন দরকার নাই।
নাম পরিবর্তনের নজির বিশ্বে ১৬টি দেশের রয়েছে। দেশের অধিকাংশ জনগণ যদি মনে করে নাম পরিবর্তন করা যেতে পারে তবে নাম পরিবর্তন করা দোষের কিছু নয়। একজনকে পছন্দ না হলে, তার সকল কিছুই দোষের মনে হবে।
যারা একজন স্বৈরাচারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মনে করছে তারা বিশ্ব জয় করে ফেলেছে, তাদের জন্য মরন চাঁদের উদাহরণটা অসাধারণ। এতো সহজ কথায় বিষয়টি বুঝিয়ে দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
যারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন করতে চাই তাদেরকে বলতে জানিয়ে দিতে চাই এই বাংলাদেশ কারো বাবার কোম্পানি নয় যে চাইলেই যা ইচ্ছা তাই নাম রেখে দিলাম। সাধু সাবধান এই দেশের মালিক আমরা জনগণ
সবাই তলে তলে দেশ কে লুটে খাবার ধান্দা। নামকরণ হলো নাটকের নাম। নাটকের সকল চরিত্র হলো সরকার নামক প্রতিষ্ঠান। সংস্কার, শহীদ, দুর্নীতি, ঘোষ, ইত্যাদি সরকার না করলে করে কে ??