অনলাইন
পর্যালোচনা
নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র আসিফ মাহমুদের রূপান্তর
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার
যে-বিপ্লবী একদিন রাষ্ট্রের কামান ও গুলির সামনে দাঁড়িয়েও ভীত হননি, মৃত্যুকে সংবর্ধিত করার অনুপ্রেরণা লালন করতেন, নিজের প্রাণ উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকতেন-হঠাৎ করে তিনি নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নে পিস্তল কিনলেন এবং অস্ত্রের লাইসেন্স গ্রহণ করলেন-এই পরিবর্তন কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক-নৈতিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ।
এটি একজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তের পেছনে লুকিয়ে থাকা সমাজের গভীর মনস্তত্ত্ব এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সংস্কৃতির প্রতিফলন। এর পর্যালোচনা জরুরি। কারণ, একজন সাহসী প্রতিবাদীর এমন রূপান্তরের ভেতর দিয়েই সমাজের গতি-প্রকৃতি এবং ক্ষমতার অন্তর্নিহিত ভাষা প্রকাশিত হয়।
’২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার অসম সাহসিকতা আমাদের জানা। তার অবস্থান ছিল কেবল কেন্দ্রে নয়; ইতিহাসের নির্মাণস্থলে।
স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কোটা আন্দোলন যখন দানা বাঁধছিল, তখন সেটিকে সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে রূপান্তরিত করার নেপথ্য কারিগরদের একজন তিনি। শুধু রাজপথে নয়, ছিলেন আন্দোলনের কৌশল নির্মাণেও। সেই অনিশ্চিত, দুঃসাহসিক সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ শিরোনামে একটি বইও লিখেছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী যখন জনতার বুকে বন্দুকের নিশানা করেছিল, তখন আসিফ মাহমুদ সেই নিপীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন বুক চিতিয়ে-নিরস্ত্র, কিন্তু নির্ভীক। তিনি মাথা নোয়াননি, বরং মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রাজপথে তৈরি করেছিলেন এক অপরাজেয় নৈতিকশক্তি। মিছিলের পর মিছিলের শব্দে প্রকম্পিত হয়েছিল শহরের প্রতিটি চত্বর, তার ভূমিকা ও পদচারণায় আস্থা পেয়েছিল অস্থির সময়।
গণ-অভ্যুত্থানে আসিফ মাহমুদ যে, নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, তা নিছক শারীরিক সাহস নয়; এটি ছিল নৈতিকদৃঢ়তা, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের এক গভীর শক্তি। তার সেই সময়কার অস্ত্র ছিল-জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, নৈতিক ন্যায্যতার চেতনা, মৃত্যু ভয়কে অতিক্রম করার বিপ্লবী মানসিকতা।
পিস্তলের লাইসেন্স: নিরাপত্তার বোধ নাকি ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি?
পিস্তলের লাইসেন্স করা মানে নিছক নিরাপত্তা নয়; বরং এটি একপ্রকার Surveillance mentality- নিজেকে ‘Target’ হিসেবে কল্পনা করা এবং নিজের ব্যক্তিগত সুরক্ষার নামে নিজেকে সশস্ত্র করা। আসিফ মাহমুদের অস্ত্র ধারণক্ষমতার অহংকার শুধু নয় বরং ক্ষমতার চূড়ায় উঠে আবার ভীতু হয়ে পড়ার মনস্তাত্ত্বিক নিঃসঙ্গতাও প্রকাশ পেয়েছে। তিনি এখন আর জনগণের রক্ষাকবচ নন, বরং নিজের জন্য প্রহরী খোঁজা একজন ভীতসত্তা। ‘Surveillance mentality’। অর্থাৎ নজরদারি-মনস্কতা, একধরনের মানসিক অবস্থা যেখানে মানুষ সবসময় বিশ্বাস করে যে, সে কারও নজরে আছে, কেউ তার গতিবিধি লক্ষ্য করছে এবং সে এক ‘টার্গেট’। যখন কেউ ক্ষমতা বা অর্থের উচ্চতায় উঠে যায়, তখন তার মনে জন্মায় একধরনের অনুভূতি-‘আমি এখন বিপদে পড়তে পারি।’ সে ভাবে-যারা একসময় আমার পাশে ছিল, এখন তারাই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে। এই মানসিকতা তাকে বাস্তব বা কাল্পনিক ‘শত্রু’র সন্ধানে রাখে। ফলে, সে নিজের সুরক্ষার জন্য অস্ত্রে ভরসা রাখে।
নিজেকে টার্গেট কল্পনা করা, ‘আমি গুরুত্বপূর্ণ, আমি নজরদারির কেন্দ্রে-সুতরাং আমি ঝুঁকিতে’।
এখানে অস্ত্র হয়ে ওঠে-আত্মরক্ষার প্রতীক নয় বরং ‘আমাকে কেউ ঘাঁটাবেন না’-এই ভয়ের উত্তরে একরকম ক্ষমতা প্রদর্শন।
ক্ষমতা-সম্পদের অহংবোধ: গণ-অভ্যুত্থানে অসম সাহসিকতা তাকে এনে দিয়েছিল সম্মান; কিন্তু সেই সম্মানের মূলে ছিল জনগণের ভালোবাসা। তিনি যখন অস্ত্রকেই নিরাপত্তা মনে করেন, তখন তিনি আর জনগণের কাতারে নেই। তিনি এখন একা-ক্ষমতার নিঃসঙ্গ ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রতিচ্ছবি। আর এই নিঃসঙ্গতা তাকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা থেকে ছিন্ন করেছে। অহংকারের একটি মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হলো-‘আমি যা অর্জন করেছি, তা হারানোর ভয়।’ ক্ষমতা ও অর্থ মানুষকে একধরনের কৃত্রিম নিরাপত্তা দেয়, যা আবার সহজেই ভঙ্গুর। এই ভঙ্গুরতা থেকেই জন্ম নেয় অস্ত্রের প্রতি নির্ভরতা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর যারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন রাতের আঁধারে, তাদের অনেকের সীমাহীন টাকা এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র ছিল- কিন্তু কেউ নিরাপত্তা বোধ করেননি। অস্ত্র কাউকে সুরক্ষাও দেয়নি। এ থেকে আমরা কেউ শিক্ষা নেই না।
নৈতিকতার অবক্ষয়: নিরস্ত্র অবস্থান একধরনের নৈতিক দৃঢ়তা দাবি করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন তার নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয় বা স্বার্থের সঙ্গে আপস করে, তখন মানুষ নিজেকে অস্ত্র দিয়ে নিরাপদ রাখতে চায়। পিস্তলের আবরণে বিবেকের শূন্যতা ঢাকতে চায়। নৈতিক দৃঢ়তা হারালে অস্ত্রই হয় শেষ ভরসা। পিস্তল তখন আত্মবিশ্বাসের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা এক আত্মগ্লানি।
গণ-অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা: ছাত্র-সমাজ, শ্রমিক-শ্রেণি, সর্বস্তরের জনগণ, শিল্পী-সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল আর এর মাধ্যমেই পরাক্রমশালী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু পরবর্তীতে কারও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রের প্রয়োজন পড়েনি, শুধু প্রয়োজন পড়েছে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোদ্ধা, আন্দোলনের সতীর্থ নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, বাকের মজুমদার, হাসনাত আব্দুল্লাহ, উমামা ফাতেমা-সহ অসংখ্য বিপ্লবীর ব্যক্তিগত অস্ত্র সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়লো না, অথচ আসিফ মাহমুদের জন্য অস্ত্র অনিবার্য হয়ে পড়লো। এই অস্ত্র একদিন আসিফ মাহমুদকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, ইতিমধ্যে করেছেও।
রূপান্তরের ট্র্যাজেডি: তিনি এক সময় ছিলেন জনগণের স্বপ্ন ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি-ভরসার মুখ, সাহসের প্রতীক। কিন্তু অস্ত্রে বিশ্বাস স্থাপন মানে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলার সূচনা। যে মানুষটি একদিন ভালোবাসায় নিরস্ত্র হয়ে চলতে পারতেন, আজ তার চলার সঙ্গী গুলিবর্তী পিস্তল। এই অস্ত্র কেবল ব্যক্তিগত আতঙ্কের নয়, বরং জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। এই অস্ত্রই আসিফ মাহমুদকে বড়ো অনিরাপদ করে ফেলবে। এ ভয় একজন ব্যক্তির নয়-তা পুঞ্জীভূত ট্র্যাজেডি, যেখানে সমাজ, রাজনীতি এবং নৈতিকতা-সবই একসঙ্গে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের উপর বিশ্বাস হারানো মানেই বিপ্লব থেকে বিচ্যুতি আর অস্ত্র হাতে নেয়া মানেই সেই বিচ্যুতিকে স্থায়ী করে ফেলা। গণ-অভ্যুত্থানের একজন উজ্জ্বল মুখ, যিনি এক সময় জনগণের বিশ্বাসে বেঁচে ছিলেন, তিনি যদি অস্ত্রে বিশ্বাস করেন-তবে এটা তার একাকিত্বের প্রতিচ্ছবি, জনগণের উপর বিশ্বাস স্থাপনের ঘাটতি; সর্বোপরি ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নতুন স্বপ্ন বিনির্মাণে আসিফ মাহমুদের ভূমিকা রাখার সুযোগ ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিপুল সম্ভাবনা আসিফ মাহমুদ নিজ হাতেই নিজেকে হত্যা করেছেন।
জনগণের কাতারে দাঁড়াবার নৈতিক শক্তিকে, ক্ষমতার দম্ভের কাছে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে এটা খুবই ভয়ঙ্কর। আসিফ মাহমুদের পতন কেবল ব্যক্তিগত নয়-এ এক আদর্শগত পরাজয়।
তিনি ভুলে গিয়েছেন-গণ-অভ্যুত্থানের পর সত্যিকারের নেতৃত্ব আত্মরক্ষা নয়, বরং আত্ম-উৎসর্গের মধ্যেই বিকশিত হয়।
বাকি সহযোদ্ধারা যখন ভবিষ্যৎ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেছেন, তখন তিনি অস্ত্রে নির্ভর করে আত্মরক্ষা করছেন কিন্তু অস্ত্র তাকে রক্ষা করেনি, বরং নৈতিকভাবে ভেঙে দিয়েছে। ইতিহাস যারা বদলে দিতে চায়, তাদের আত্মাকে হতে হয় স্বচ্ছ, হৃদয়কে হতে হয় উন্মুক্ত আর হাতে থাকতে হয় জনতার হাত। আসিফ মাহমুদ সেই নৈতিক পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। অস্ত্র তার জন্য প্রতিরক্ষার উপায় নয়, আত্মবিচ্ছিন্নতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই বিচ্ছিন্নতা কেবল সহযোদ্ধাদের থেকে নয়, তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে ভবিষ্যতের কাছ থেকেও।
তিনি যদি বুঝতে পারতেন-নিজের হাতে নিজের কী সর্বনাশ করেছেন, তাহলে তার একমাত্র নৈতিক কর্তব্য-‘উপদেষ্টা’ এবং ‘অস্ত্র’-দু’টোই পরিত্যাগ করা। কিন্তু তিনি কোনোটাই পরিত্যাগ করতে পারবেন না। কারণ, পরিত্যাগ করতে হলে একটা নৈতিক সাহস লাগে আর সেই সাহস তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। আসিফ মাহমুদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন-যে হাত একদিন পতাকা ধরেছিল, সে হাতেই যদি অস্ত্র ওঠে, ইতিহাস তখন সেই হাতে আর আস্থা রাখে না। এই গল্প আমাদের শেখায়- যে নেতা জনতার কণ্ঠস্বর থেকে সরে দাঁড়ায়, সে একদিন জনতার স্মৃতি থেকেও মুছে যায়।
একদিন যে-মানুষটি ভবিষ্যতের মুখ হয়ে উঠতে পারতেন, আজ তিনি ইতিহাসের এক সতর্কবাণী। আসিফ মাহমুদের রূপান্তর কেবল ব্যক্তিগত নয়-এটি একটি প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনার উত্থান ও বিপর্যয়ের উপাখ্যান এবং একইসঙ্গে বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
(সূত্র- জনতার চোখ)
পাঠকের মতামত
অসাধারণ বিশ্লেষণ, সময়পোযোগী লিখনি
Wrong description