বিশ্বজমিন
ট্রাম্পের তাড়াহুড়ো: ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে নতুন কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
মানবজমিন ডেস্ক
(১ সপ্তাহ আগে) ৯ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার, ১:৪৩ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২০ পূর্বাহ্ন

ক্ষমতায় আসার পরপরই একের পর এক চমকপ্রদ পদক্ষেপের কথা জানাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফের পর সম্ভবত তার সবেচেয়ে বেশি চমক হচ্ছে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে ইরানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব। যদিও শেষ পর্যন্ত অন্য দেশের মধ্যস্থতায় বৈঠকে রাজি হয়েছে উভয় দেশ। উচ্চ পর্যায়ের ওই আলোচনার জন্য ওমানকে বাছাই করেছে মাসুদ পেজেশকিয়ানের প্রশাসন। আগামী শনিবার সেখানেই মিলিত হবে উভয় দেশ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পারমাণবিক চুক্তির আলোচনায় ট্রাম্প বেশ তড়িঘড়ি করছেন। যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
বিবিসির কূটনৈতিক করেন্সপন্ডেন্ট জেমস ল্যান্ডেল তার এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ডনাল্ড ট্রাম্প তাড়াহুড়ো করা একজন মানুষ। ক্ষমতায় আসার পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট গাজা ও ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জোর চেষ্টা শুরু করেন। তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ইয়েমেনে বোমা বর্ষণ শুরু করেছেন। বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছেন বাণিজ্য যুদ্ধের খাদে। এখন তিনি নজর দিয়েছেন ইরানের দিকে। রিপাবলিকান এই প্রেসিডেন্টের কাজের তালিকায় এটি সবসময়ই গুরুত্ব পেয়েছে। কেননা প্রথম মেয়াদে তিনি এ বিষয়টি সমাধান করতে পারেননি। ইস্যুটি তখন যেমন ছিল এখনও তেমন রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের সন্ধান থেকে কী বিরত রাখা যাবে?
ইরান বারবার এমন উচ্চাকাঙ্খার কথা অস্বীকার করলেও বিশ্বের অনেক দেশই বিশ্বাস করে যে, পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরির ক্ষমতা চায় তেহরান।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ইরানের এই উচ্চাকাঙ্খা মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এমনকি সর্বাত্মক যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। ২০১৫ সালে ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। যার নাম দেয়া হয়েছে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যকশন বা জেসিপিওএ। ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে, ইরান তার পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্খা সীমিত করবে এবং তাদের দেশে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকের প্রবেশের অনুমতি দেবে। যার বিনিময়ে তেহরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। কিন্তু ২০১৮ সালে ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন ট্রাম্প। তখন তিনি প্রথম মেয়াদে দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। তার অভিযোগ হচ্ছে, ইরান হামাস ও হিজবুল্লাহর মতো নিজের ভাড়াটে যোদ্ধাদের অর্থায়ন করছে ইরান। এর মাধ্যমে তারা সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিচ্ছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ইরানের ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
পরবর্তীতে চুক্তির কিছু বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে তেহরান। এর মাধ্যমে তারা আরও বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে পারমাণবিক জ্বালানি সংগ্রহ করতে শুরু করে। বিশ্লেষকদের ধারণা শিগগিরই পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্রের গ্রেড ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে ইরান। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) আনুমাণিক তথ্য বলছে, ইরানের ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়ামের মজুদ পরবর্তী এবং চূড়ান্ত স্তরে সমৃদ্ধ করা হলে দেশটি প্রায় ছয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম হবে।
শপথগ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যেই ইরানের ওপর তথাকথিত সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আগের নীতি অনুসরণ করেন ট্রাম্প। ৪ ফেব্রুয়ারি তার ট্রেডমার্ক ফ্যাট-টিপ কলম দিয়ে একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। যেখানে মার্কিন অর্থবিভাগকে ইরানের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের এবং বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারী দেশগুলোকে শাস্তির দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বিশেষ করে যে দেশগুলো ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন ট্রাম্প। বর্তমানে সেই অর্থনৈতিক চাপকে কূটনীতির সঙ্গে তালগোল পাকায়ে দেখার চেষ্টা করছে হোয়াইট হাউস।
গতমাসে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেখানে পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেন প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি এ বিষয়ে চুক্তির জন্যও অনুরোধ জানান তিনি। এর ধারাবাহিকতায় আগামী সপ্তাহের শনিবার ওমানে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করতে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ। এখানে ইরানের প্রতি মার্কিন হুমকি স্পষ্ট। হয় চুক্তিতে আসো নইলে সামরিক পদক্ষেপ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হও। গত সোমবার ট্রাম্প বলেছেন, যদি ইরানের সঙ্গে আলোচনা সফল না হয়, তাহলে আমার মনে হয় বড় বিপদের মধ্যে পড়বে ইরান।
এই পরিস্থিতিতে ইরানের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?
নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, তেহরান এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছতে চাইবে যাতে তারা নিষেধজ্ঞা এড়াতে পারে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রার দরপতনের কারণে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে রয়েছে ইরানের অর্থনীতি। কিন্তু এ ধরণের যেকোনো চুক্তি কার্যকর করতে আপস করতে হতে পারে, যা কট্টরপন্থীদের পক্ষে হজম করা কঠিন হবে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চতুর্মুখী চাপে পড়েছে তেহরান। ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ এবং তার আঞ্চলিক মিত্র সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতনে তাদের ভাড়াটে যোদ্ধারা মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারো কারো মতে, এখনই তেহরানকে পারমাণবিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার সর্বোত্তম সময়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, উভয় দেশের মধ্যে এখনও অনেক দূরত্ব রয়ে গেছে। কেননা তাদের আলোচনার কেন্দ্র এখনও স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে ফেলতে চায়। তেহরান যেন কোনোভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে না পারে সেদিকেই লক্ষ্য ঠিক করেছে ওয়াশিংটন। পাশাপাশি লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুথিদের জন্য যেন কোনো অর্থায়ন করতে না পারে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এসব শর্ত ইরানের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বেসামরিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও ইরানের যেকোনো পারমাণবিক নিষেধজ্ঞা তাদের জন্য চরম বিপত্তির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিবিসির ওই প্রতিবেদক বলছেন, ইরানের প্রযুক্তিগত দক্ষতার কিছু সমস্যাও রয়েছে। তাদের বিজ্ঞানীরা এখনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে এক দশক আগের পদ্ধতির বাইরে তেমন কিছু জানে না।
এদিকে ইসরাইলও চাইছে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হোক। লিবিয়ায় যেভাবে এটা করা হয়েছিল সেভাবে করার কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এখানে বলে বলে রাখা ভালো, ২০০৩ সালে নিষধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে সম্পূর্ণরূপে পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি। ইরান সাবেক ওই প্রেসিডেন্টের পথে হাঁটবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা ব্যর্থ হলে কি হবে?
ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করতে দীর্ঘদিন ধরে সামরিক বিকল্প বিবেচনা করে আসছে ইসরাইল। কিন্তু তাদের অনেকেই ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারের গভীরে চাপা পড়ে আছেন। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানে হামলার জন্য কেবল মার্কিন সহায়তা পেলেই হবে না, দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করতে স্থলভাগে ইসরাইলের বিশেষ বাহিনীর প্রয়োজন হতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে সামরিক পদক্ষেপ ইসরাইলকে বেশ ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এছাড়া এর সাফল্য নিয়েও সংশয় রয়েছে।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে বিশ্ববাসীকে কথিত ‘চিরদিনের যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরানকে নিয়ে সর্বাত্মক আঞ্চলিক সংঘাত এড়ানো তার প্রতিশ্রুতির একটা হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ইসরাইলকে এখনও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তেল আবিবের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে বি২ যুদ্ধবিমান দিয়ে সহযোগিতা করছেন ট্রাম্প। এমন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে ট্রাম্প কূটনৈতিকভাবে সমাধান খুঁজছেন। এমন একটি সমাধান সন্ধান করছেন যা ইসরাইলকে তার বিধান নির্বিশেষে একটি বাস্তব সমাধানের পথে এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু যদি কোনো চুক্তি না হয় তাহলে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। এছাড়া চুক্তিতে সম্মত হতে দুই মাসের সময় বেধে দিয়েছেন ট্রাম্প। এক্ষেত্রে ট্রাম্প হয়ত ভুলে গেছেন জেসিপিওএ এর চুক্তিতে পৌঁছাতে দেশগুলোর দুই বছর সময় লেগেছি। তাড়াহুড়ো করে কূটনৈতিক সমাধান পাওয়া যায়ন।