শরীর ও মন
চিকিৎসা ব্যতীত মৃত্যু নয়
ড. জিয়া হায়দার
(১ সপ্তাহ আগে) ২৯ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ৩:৪৫ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:৪৯ অপরাহ্ন

বিশ্ব ব্যাংকের হয়ে ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়ায় কর্মরত ছিলাম। কম্বোডিয়া ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ লাও পিডিআরও আমার কাজের আওতাভুক্ত ছিল। এই দু’টি দেশের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন ছিল আমার কাজের মূল ফোকাস।
কম্বোডিয়ার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে আমার পর্যবেক্ষণ ও সামান্য অবদান খুব সংক্ষেপে আজ তুলে ধরতে চাই। খেমার রুজ শাসনামলের পরবর্তী সময়ে কম্বোডিয়ার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। ১৯৭৫–১৯৭৯ সালের শাসনামলে স্বাস্থ্য খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হন বা দেশত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৮০ সালে শনাক্তকৃত ডাক্তারদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ জন। পরবর্তীতে সরকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও তারা স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেয়।
কিন্তু ২০১৬–১৭ সাল পর্যন্ত দুটি প্রধান বাধা কম্বোডিয়ার স্বাস্থ্য খাতকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। এর একটি ছিল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের নিম্ন মান, আরেকটি ছিল দারিদ্র্যের কারণে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অসমর্থতা। আমরা এই দু’টি প্রধান বাধা দূর করার লক্ষ্যে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করে দেশব্যাপী বাস্তবায়নের জন্য একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য প্রকল্প প্রণয়ন করি।
এই প্রকল্পের মূল ছিল স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের মাধ্যমে, প্রথমত দেশের প্রতিটি হাসপাতালকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং এই জবাবদিহিতার সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ, তথ্যভিত্তিক ইনসেনটিভ কাঠামো যুক্ত করা। দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র দরিদ্র পরিবারের জন্য একটি সামাজিক ইনস্যুরেন্স স্কিম চালু করা, যার মাধ্যমে তাদেরকে বিনামূল্যে দেশের যেকোনো সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেয়া যায়। সামাজিক স্বাস্থ্য ইনস্যুরেন্সের অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগের হাতে। বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা যেমন অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি প্রকল্পটিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে সম্মত হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—এই প্রকল্পের সামাজিক ইনস্যুরেন্স কম্পোনেন্টটি প্রথম দিন থেকেই জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যান্য খরচেরও অর্ধেক বহন করে কম্বোডিয়া সরকার।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়িত সংস্কার কর্মসূচি যুদ্ধবিধ্বস্ত কম্বোডিয়ার পিছিয়ে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নে সহায়ক হয়। বিশেষ করে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে উন্নত সেবা প্রদানের উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে যায়, হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটির অংশগ্রহণ বাড়ে, স্বাস্থ্যসেবার মানে ব্যাপক পরিবর্তন আসে, রোগীদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সর্বোপরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যায়।
কম্বোডিয়ার মতো আরও অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে স্বাস্থ্য খাতে জরুরি সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দৃশ্যমান সুফল পাওয়া গেছে। তবে এই সুফল পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো—দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ নেতৃত্ব, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা।
স্বৈরাচারের পতনের পর বাংলাদেশেও এই উপাদানগুলোর কয়েকটির উপস্থিতি মোটামুটি দৃশ্যমান। আশা করব, আগামীর নির্বাচনে যেই সরকার গঠন করুক না কেন, তারা বাংলাদেশের গনমানুষের বহু বছরের জমিয়ে রাখা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করবে এবং বাংলাদেশের ঘুণে ধরা স্বাস্থ্য খাতকে সংস্কারের মাধ্যমে ঢেলে সাজাবে। আমাদের লক্ষ্য থাকবে—সবার জন্য স্বাস্থ্য এবং ‘চিকিৎসা ব্যতীত মৃত্যু নয়’—৩১ দফার এই স্লোগানকে বাস্তবে রূপ দেয়া।
লেখক: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
পাঠকের মতামত
Thank u