বিশ্বজমিন
আল জাজিরার রিপোর্ট
মুরিদকে হামলা: সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি নাকি মসজিদ?
মানবজমিন ডেস্ক
(৮ ঘন্টা আগে) ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন

ভবনের ছাদ বিপজ্জনকভাবে ঝুলে পড়েছে। একটি গর্ত দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছে। নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ধ্বংসাবশেষ। কক্ষগুলোর দরজা বিস্ফোরণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এটি পাকিস্তানের মুরিদকে শহরের বিশাল একটি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ভারতের হামলায় তা এখন বিধ্বস্ত। মুরিদকে লক্ষ্য করে চালানো এই হামলা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতসহ অনেক দেশের দাবি, এখানে লস্কর-ই-তৈয়বা গোষ্ঠীর ঘাঁটি অবস্থিত। তারা ২০০৮ সালের মুম্বই হামলার মতো ভারতীয় ভূখণ্ডে নৃশংস হামলার জন্য অভিযুক্ত।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি দাবি করেন, হামলার লক্ষ্য ছিল ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ এবং শুধু সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেই নিশানা করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান জানিয়েছে, এ হামলায় বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। হামলার পর মুরিদকের যে ভবনটির ছাদ ধসে পড়ে তা ছিল সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক ভবন। এই কমপ্লেক্সে একটি হাসপাতাল, দুটি স্কুল, একটি হোস্টেল এবং একটি বড় মাদরাসা আছে। সেখানে ৩,০০০-এর বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। এখানে ৮০টি আবাসিক ভবনে প্রায় ৩০০ জন বাস করেন। তাদের বেশিরভাগই সরকারি কর্মচারী। হামলায় প্রশাসনিক ভবনের পাশাপাশি একটি মসজিদও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তিনজন কর্মচারী নিহত হন। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। আহত হন আরও একজন।
আমরা আগেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম
ইসলামাবাদ থেকে চার ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত প্রায় আড়াই লাখ জনসংখ্যার ছোট শহর মুরিদকে। লাহোর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। সরকারি কর্মকর্তা তৌসিফ হাসান বলেন, মুরিদকেই মঙ্গলবার রাতের প্রথম লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল। তার ভাষায়, আমি ঠিক রাত বারোটার কিছু পরে দুটি বিশাল বিস্ফোরণের শব্দ শুনি। আমরা জানতাম এটা হতে পারে এবং আমরা প্রস্তুত ছিলাম। হাসান এবং তার সহকর্মী উসমান জালিস জানান, পেহেলগাম হামলার পর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মুরিদকে হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্যস্থল হিসেবে বিবেচনা করে এবং বাসিন্দাদের জায়গা ছাড়ার নির্দেশ দেয়। নিহতরা ছিলেন সেসময় সেখানে থাকা অল্প কিছু কর্মচারি।
বারান্দার একপাশে একটি টেবিলে ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ রাখা ছিল। এখনও ধাতব টুকরাগুলোতে বিস্ফোরকের গন্ধ এবং উত্তাপ অনুভূত হচ্ছিল। যদিও হাসান ও জালিস জোর দিয়ে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এর ইতিহাস আরও জটিল।

শিক্ষা না কি উগ্রবাদ?
১৯৮৮ সালে জামায়াত-উদ-দাওয়া প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদ এই কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠা করেন। জামায়াত উদ দাওয়া আন্তর্জাতিকভাবে লস্করে তৈয়বার ফ্রন্ট হিসেবে বিবেচিত। এখানে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার নাম জামিয়া দাওয়াহ ইসলামি। ভারত হাফিজ সাঈদ ও লস্করে তৈয়বাকে একাধিক সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী করে, বিশেষ করে মুম্বই হামলা। কমপ্লেক্সে থাকা ৫১ বছর বয়সী ধর্মীয় শিক্ষক আবিদ হোসেন ভারতের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এই স্থাপনাটি সবসময়ই একটি শিক্ষাকেন্দ্র। ছেলে-মেয়েরা এখানে পড়াশোনা করে। আমি নিজে তিন দশক ধরে এখানে শিক্ষকতা করছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের সাঁতার, ঘোড়ায় চড়া বা শারীরিক অনুশীলনের সুযোগ থাকলে, তা কি সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণের প্রমাণ?
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার জামায়াত উদ দাওয়ার কাছ থেকে কমপ্লেক্সটি নিজেদের দখলে নেয়। তখন থেকেই কারিকুলাম ও শিক্ষা কার্যক্রম সরকারি তত্ত্বাবধানে চলে। মসজিদের পেছনে একটি গলি দিয়ে দেখা যায়, দুটি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। সৌর প্যানেল ও ভাঙা ইট সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। একজন স্থানীয় বাসিন্দা আলী জাফর বলেন, কয়েকদিন আগে আমাদের জায়গা ছাড়তে বলা হয়েছে। তাই পরিবার নিয়ে আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই। ভারত যে এখানে হামলা চালাবে, সেটা নিশ্চিত ছিল। সরকারি কর্মকর্তা হাসান জানান, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম এরই মধ্যে বন্ধ করা হয়েছিল এবং কঠোর নজরদারিতে ছিল। ধর্মীয় শিক্ষক হোসেন বলেন, সরকার দখলের পর হাফিজ সাঈদ আর কমপ্লেক্সে আসেননি। তিনি আগে নিয়মিত আসতোন। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে আর আসেননি।
হাফিজ সাঈদকে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২২ সালে সন্ত্রাসী অর্থায়নের দুটি মামলায় ৩১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত তিনি। এর আগেই তিনি ২০২০ সালে ১৫ বছরের একটি রায়ে সাজাপ্রাপ্ত হন।