শেষের পাতা
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণ
‘পৃথিবীর সেরা বইগুলো থেকেই আনন্দ খুঁজে নিতে হবে’
স্টাফ রিপোর্টার
১০ মে ২০২৫, শনিবার
শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের বাইরে বিভিন্ন বই পড়তে উৎসাহিত করেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেন, পাঠ্য বইয়ে আলো খুঁজে পাওয়া যায় না। পাঠ্য বই হলো চাকরি, বৈষয়িক উন্নতি। কাজেই পাঠ্য বইয়ের বাইরে পৃথিবীর সেরা লেখকরা যা লিখেছেন, সেটা জানতে হবে। সেখানে আনন্দ খুঁজে বের করতে হবে। গতকাল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আয়োজিত দুই দিনব্যাপী বইপড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের উদ্বোধনী পর্বে এসব কথা বলেন তিনি।
বইপড়াকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে বইপড়া নিয়ে নানা কর্মসূচির আয়োজন করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আলোকিত মানুষের সন্ধানে সাতচল্লিশ বছর ধরে সারা দেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য নানাবিধ উৎকর্ষ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। দুই দিনব্যাপী বইপড়া কর্মসূচির প্রথম দিনে গতকাল কৃতিত্বের জন্য ঢাকা মহানগরের ২ হাজার ৫০০শ’ ৬৩ জন শিক্ষার্থীকে পুরস্কার তুলে দেয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে বর্ণিল আয়োজনে রাজধানীর শিক্ষার্থীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন পর্ব অতিথি ছিলেন, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, বাংলা একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, সাবেক সচিব খন্দকার মো. আসাদুজ্জামান, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম, গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুন প্রমুখ।
বাংলা একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, বইকে গুরুত্ব না দিলে মানুষের সভ্যতা উন্নতির দিকে যাবে না। স্ক্রিনে পড়া আর ছাপা কাগজে পড়ার মধ্যে ভিন্নতা আছে। এখানে মতপার্থক্যও আছে। অনেকেই বলেন, বই মানুষকে ভেঙে নতুন করে গঠন করে। তিনি বলেন, বইয়ের মধ্যে যে ভালোমন্দ আছে, তা বিচার করতে হবে। মহাত্মা গান্ধী একটা কথা বলেছেন, বেশি বই পড়ে মানুষ ভালো মানুষ হয় না। ভালো মানুষ হয় ভালো বই পড়লে। বইয়ের মধ্যে ভালো-মন্দ বিচার করতে হবে।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শিক্ষার্থীদের বলেন, আজকে যারা এখানে এসেছেন, তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বহু কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা সংস্কারে কোনো কমিশন করেনি। সরকার শিক্ষাবৈষম্য দূর করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তাই সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা কাঠামো তৈরি করবে আশা করি।
যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি বিখ্যাত উক্তির উল্লেখ করে বলেন, বইয়ের চাইতে বিশ্বস্ত বন্ধু আর কেউ নেই, কিছু নেই। তাই ছাত্রছাত্রীদের বেশি বেশি করে বই পড়তে হবে।
তৃতীয় পর্বের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সূচনালগ্নের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছেন, তখন উনাকে অনেকেই পাগল বলেছেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্য থেকে একবারও সরেননি। দীর্ঘ পথ চলায় সততা ছিল তার সঙ্গী। তিনি মনে করতেন, আমি একদিন লক্ষ্যে পৌঁছাবই। তিনি পৌঁছাতে পেরেছেন।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সায়ীদ স্যার আমাদের শক্তি, আমাদের সাহস। আমরা একজন অবিভাবক পেয়েছি। আর তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্লোগান ‘আলোকিত মানুষ চাই।’ স্যার বলবেন, এটা কোনো মতাদর্শ নয়। কিন্তু আমি বলবো, এটার মতাদর্শ অবশ্যই আছে। সমাজে ‘আলোকিত মানুষ’ নেই বলেই তিনি ‘আলোকিত মানুষ’ চেয়েছেন।
মোবাইল ফোন ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন- অনেকেই বলেন, মোবাইল ফোন মানুষের শত্রু। হ্যাঁ, এটা শত্রু, আবার বন্ধু। ভালো জিনিসও মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়, সেটা দেখতে হবে। এটি বই পড়ার সহায়ক হতে পারে ।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রচারবিমুখ মানুষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক পুরস্কারই তিনি পেয়েছেন, কিন্তু স্যারের আরও বড় পুরস্কার পাওয়ার কথা। আমি বিশ্বাস করি, তিনি ভবিষ্যতে আরও বড় পুরস্কার পাবেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, রবীন্দ্রনাথের একটা কথা আছে, আমাদের জন্য ৬ ফুটই যথেষ্ট। কিন্তু মানুষ তো ৬/৭ ফিটের মধ্যে বাঁচতে পারে না। মানুষের ভেতরে অসীম একটা শক্তি আছে। যা প্রকাশিত হয় অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। তা হয় একমাত্র বইয়ের মাধ্যমে। অন্যের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে নিজের মধ্যে যে সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনা থাকে তা প্রকাশিত হতে পারে। জীবনটাও তেমনই। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন, তা হলেই মানুষ বাঁচতে পারে না।
গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ বলেন, তরুণদের জ্ঞানের বিকাশ এবং মানসিক উৎকর্ষতার জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই। তাই আলোকিত মানুষ গড়ার অংশ হিসেবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যে বইপড়া কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এমন একটি উদ্যোগের অংশ হতে পেরে আমরাও গর্বিত।
উল্লেখ্য, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা মহানগরের ৭৫টি স্কুলের প্রায় ২০,০০০ ছাত্রছাত্রী বইপড়া কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে। এসব স্কুলের ৫ হাজার ৯৪ জন শিক্ষার্থী মূল্যায়নপর্বে বিজয়ী হয়েছে। বিজয়ী শিক্ষার্থীদের ১১৫৭ জন ছাত্র ও ৩৯৩৭ জন ছাত্রী।