অনলাইন
কূ ট নী তি
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি
মিজানুর রহমান
(১২ ঘন্টা আগে) ১২ মে ২০২৫, সোমবার, ৭:৫৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:১৬ পূর্বাহ্ন

চির বৈরী ভারত-পাকিস্তান। বহু বছর পর ফের যুদ্ধের মহড়া দিলো। তবে তারা আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণের মধ্যে এখনো সীমাবদ্ধ। দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চলমান সংঘাত বড় আকারে বা দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা- তা এখনো অনুমান করা মুশকিল। তবে এটা সর্বজনবিদিত যে, পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে সেই উত্তাপ নিজ বাড়ি অবধি আসে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের চূড়ান্ত পরিণতি ‘যুদ্ধ’ হলে বাংলাদেশসহ গোটা অঞ্চলেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে কোনো পক্ষাবলম্বন না করে পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটাকে এখনো কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। ভারত, পাকিস্তান বা ভিনদেশিদের প্রতি বাংলাদেশে আনুগত্যশীল মানুষ অনেক। বিশেষ করে এ দেশের মূলশক্তি ‘মধ্যবিত্ত’ যাদের জ্ঞানী-গুণী ভেবে একটু কদর করে সেই তথাকথিত সুশীলদের ব্যবসা এটাই!
তারা যতটা না বাংলাদেশপন্থি তারচেয়ে ঢের দিল্লি, ইসলামাবাদ, মস্কো বা আমরিকাপন্থি বলে নিজেকে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। দেশমাতৃকার প্রতি ভালবাসা তথা তাদের ন্যূনতম দরদটা যদি থাকতো তাহলে বাংলাদেশের আজ এই চেহারা হতো না!
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে না জড়ানোর যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। রেশিও হিসেবে এটি ৭০-৩০। কিন্তু সেই আশঙ্কা যত কমই থাকুক না কেন এটি বেঁধে গেলে বাংলাদেশের ক্ষতি অপূরণীয়। বিশেষ করে অর্থনীতি, রাজনীতি, মধ্যবিত্ত সমাজ তথা দেশের সর্বত্র এর বহুমুখী প্রভাব পড়বে। বুধবারের মহড়া থেকে সেটা অন্তত অনুমেয়। বিদ্যমান উত্তেজনায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নতুন করে বড় ধাক্কা খেয়েছে। সেই সংঘাতের প্রত্যক্ষ অংশীদার না হয়েও এর উত্তাপ থেকে রেহাই পায়নি বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়া। পরোক্ষ অভিঘাতে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে গেছে এরইমধ্যে। উত্তেজনার ক্ষতি আর যাই হোক- দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। আন্তঃসীমান্ত তথা আকাশ, জল ও স্থলপথে তৈরি হয়েছে অজানা আতঙ্ক। মানুষ এবং পণ্যের অবাধ চলাচল ও সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। বুধবার নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত-পাকিস্তান গোলাগুলি চলাকালে দেশ দু’টির আকাশসীমা এড়িয়ে চলতে হয়েছে বাংলাদেশকে। শুধু তা-ই নয় পাকিস্তানকে লক্ষ্যবস্তু করে আরব সাগরে অভিযান চালিয়েছে ভারত। ফলে এ অঞ্চলের সমুদ্রগামী পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে তখন বিকল্প পথ ব্যবহার করতে হয়েছে। খেলাধুলাসহ অন্য রুটিন অনেক এক্টিভিটিসে প্রভাব পড়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের কারণে ভারতের ২৪টি বিমানবন্দরে বেসামরিক সেবা বন্ধ। নিরাপত্তা শঙ্কায় অনেক ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। স্থগিত করা হয় ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ আসর আইপিএল। ভারত-পাকিস্তান এই সংঘাত বন্ধে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস যে আহ্বান জানান, সেখানে তিনি বলেন, দুই প্রতিবেশীর সামরিক সংঘাতের ভার বিশ্ব বহন করতে পারবে না। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ধরে চলা ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ফ্লাইট বাতিল ও রুট পরিবর্তনে হিমশিম খায় আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থাগুলো। ভারত ও পাকিস্তানে প্রায় পাঁচ শতাধিক ফ্লাইট বাতিল হয়।
পাকিস্তানে আক্রমণের ক’ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে শেয়ারের দরপতন শুরু হয়। তড়তড়িয়ে নামতে থাকে সূচক। যুদ্ধ লেগে যাওয়ার আশঙ্কায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রতিবেশী দেশ দু’টি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ালে পুঁজিবাজারের চিত্র কি হতে পারে তা বুঝতে গবেষণা জরুরি নয়। তারপরও চূড়ান্ত বিচারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আগামী কী ধরনের সম্পর্ক হবে? বিশেষত: পরিস্থিতি কতটা অবনতি ঘটবে? যুদ্ধ লেগে গেলে সার্বিক ভাবে কী কী সমস্যা হবে? তা নিয়ে নিশ্চয়ই বাংলাদেশে সরকারিভাবে গবেষণা হচ্ছে এবং হবে। তবে হ্যাঁ, সার্বিক একটি চিত্র পেতে ‘প্রাক্কলন’টা জরুরি। সেই সঙ্গে এর সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় এখনই দেশের নীতিনির্ধারকদের কৌশল ঠিক করতে হবে। দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় সম্প্রতি এ নিয়ে বেশক’টি পর্যালোচনা ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়, ঠিক যুদ্ধ না হয়ে যদি দেশ দু’টির মধ্যে যুদ্ধ, যুদ্ধ ভাব থাকে তাতেও বাংলাদেশের অর্থনীতি, যোগাযোগসহ বহুমাত্রিক প্রভাব পড়বে। আমদানি-রপ্তানি তথা সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই এখনই এর বিকল্প ভাবতে হবে। সে ক্ষেত্রে ‘প্ল্যান বি’ তৈরির সুপারিশ এসেছে। বলা হয়েছে- ঐতিহাসিক কারণেই ভারতের পশ্চিম সীমান্ত অস্থির হলে পূর্ব সীমান্ত অর্থাৎ বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ে। যেকোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে কাছের এবং দূরের দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার এই সংঘাতকে অব্যাহতভাবে নিরুৎসাহিত করে যেতে হবে। কোনো ফর্মে কোনোভাবেই নয়াদিল্লি বা ইসলামাবাদ- কারও পক্ষাবলম্বন দূরে থাক, ন্যূনতম ঝুঁকে পড়া বা ফুয়েলও দেয়া যাবে না।
রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে বিদায় নেয়া শেখ হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে ছিল অতিরিক্ত মাখামাখি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল যে, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচনে প্রার্থিতার প্রশ্নেও ভারতীয় প্রভাবের বিষয়টি আলোচনায় আসতো। আমরা যেন দিল্লির বাইরে কিছুই চিন্তা করতে পারতাম না। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চলে গিয়েছিল ডিপ ফ্রিজে। ৫ই আগস্টের পর থেকে দেশ দু’টির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের রসায়ন বদলেছে। দিল্লি ইউনূস সরকারের ওপর গোস্সা। তারা অনেক কিছু থেকে দূরে। যদিও ঢাকা কাছাকাছি থাকার এবং সম্পর্ক অটুট রাখার বার্তা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্পর্কে সবচেয়ে ক্ষতি করছে ভারতীয় মিডিয়া। একটি অংশ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচারণায় ব্যস্ত। দেশটির সরকার এবং রাজনীতিবিদরা হাসিনার শোচনীয় পরাজয় ও পলায়নকে এখনো মেনে নিতে পেরেছেন বলে দৃশ্যমান কোনো সাইন নেই।
অন্যদিকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে চাইছে। ঢাকাও সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পক্ষে। উভয়ের মধ্যে একটি বোঝাপড়া শুরু হয়েছে। সফর বিনিময়, আলাপ-আলোচনা বেশ দূর এগিয়েছিলো। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সমুদয় উদ্যোগ আটকে গেছে। বরং উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশে পুশইন করেছে ভারত। সীমান্তের জমি নিয়ে নতুন করে বিরোধিতা শুরু হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে গেছে। সম্পর্কের টানাপড়েন সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশ থেকে আমাদের অনেক খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘাত স্থায়ী হলে নিশ্চিতভাবে আমদানীনির্ভর সেসব পণ্যের দাম বাড়বে। ফলে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাপে ফেলবে। শুধু তাই নয়, এটি গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।
উল্লেখ্য, ভারত-পাকিস্তান বহুবার মুখোমুখি হয়েছে। ’৪৮, ’৬৫, ’৭১ এবং সর্বশেষ কারগিল যুদ্ধ, যদিও এটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দু’-চার সপ্তাহ স্থায়ী ছিল। কিন্তু তখন কারো হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না। এখন তো দু’দেশের মজুতেই ভয়াবহ এই মারণাস্ত্র রয়েছে। ফলে কোন এক পক্ষ ট্রিগারটা চাপলেই হয়!
সূত্র: জনতার চোখ