প্রথম পাতা
অনন্য সাধারণ একজন মনু মিয়া
আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে
২১ মে ২০২৫, বুধবার
মনু মিয়া। শেষ ঠিকানার কারিগর। টানা ৪৯ বছর ধরে অকৃত্রিম আবেগে যিনি নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন শেষ ঠিকানা সাজানোর কাজে। নিজ গ্রাম বা দূরবর্তী গ্রাম, যেখান থেকে যখনই কারও মৃত্যু সংবাদ পান, ঘোড়াটির পিঠে হাতিয়ার-যন্ত্রের বস্তাটা তুলে আবেগতাড়িত দরদ নিয়ে ছুটে যান মনু মিয়া নামের এই সওয়ারি। মনু মিয়ার মতোই ‘বাহাদুর’ নামের ঘোড়াটিও প্রিয় হয়ে ওঠে হাওর জনপদের আপামর মানুষের কাছে। মনু মিয়া তার হাতিয়ার-যন্ত্রের বস্তা নিয়ে যখন ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটতেন, সবাই বুঝতেন- নিশ্চয়ই কেউ মারা গেছেন। নিঃসন্তান মনু মিয়ার সন্তানসম সেই ঘোড়াটিই এবার বর্বরতার বলি হয়েছে! বেদম পেটানোর পর বুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে ঘোড়াটিকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ঘোড়াটির নিথর দেহ ফেলে রাখা হয় একটি জমির কাদামিশ্রিত পানির মধ্যে। গত শুক্রবার সকালে যখন মৃত অবস্থায় ঘোড়াটিকে শনাক্ত করা হয়। তখনো ঘোড়াটির বুক থেকে রক্ত ঝরছিল আর সেই রক্ত মিশে লাল হয়ে ওঠে জমির পানি। ঘোড়াটিকে নির্মমভাবে মেরে ফেলার খবর রোববার পর্যন্ত জানানো হয়নি তার সওয়ারি মনু মিয়াকে। কেননা, মনু মিয়া নিজেই এখন রয়েছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একরকম মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।
মনু মিয়ার এমন সংকটকালে তার প্রিয় ঘোড়াটিকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলার ঘটনাটি নিয়ে শনিবার মানবজমিন প্রথম সংবাদ প্রকাশ করে। বিষয়টি মানুষকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। নেটিজেনরা সরব হন বোবা প্রাণীটির সঙ্গে ঘটে যাওয়া বর্বরতার বিরুদ্ধে। নিরীহ প্রাণীটিকে হত্যার ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না এলাকাবাসীসহ বিবেকবান মানুষেরা। অনেকেই মনু মিয়াকে ঘোড়া কিনে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। ঘোড়াটিকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িতরাও গত দুইদিন ধরে মনু মিয়ার স্বজন ও গ্রামবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করছেন। তারা মনু মিয়াকে একটি ঘোড়া কিনে দেয়ার কিংবা ক্ষতিপূরণ যেটিতেই সবাই সম্মত হয়- সেটি করতে চাচ্ছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনু মিয়া সোমবার সকালে কিছুটা সুস্থ বোধ করলে স্বজনদের মাধ্যমে তাকে জানানো হয় বিষয়টি। সবকিছু শুনে মনু মিয়া ঘোড়াকে মেরে ফেলার বিষয়টি জানতে ফোন দেন বাড়িতে বাহাদুরের পরিচর্যার দায়িত্ব দিয়ে আসা মহব্বতকে। মহব্বত আমতা আমতা করে খুলে বলে সবকিছু। কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে যান মনু মিয়া। পথের সাথী ‘বাহাদুর’-এর জন্য চোখ থেকে অশ্রু নামে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন।
স্ত্রী রহিমা বেগমকে জানান, কেউ যেন তার বাহাদুরের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ না নেয়। বাহাদুরের বিনিময়ে তিনি নতুন কোনো ঘোড়াও চান না। বেঁচে থাকলে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে জায়গা-জমি বিক্রি করে আরেকটি ঘোড়া কিনে নিবেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যেন ঘোড়া কিংবা ক্ষতিপূরণ নেয়া না হয়। মনু মিয়া বলেন, “আমার শুধু একটাই ইচ্ছা আছে। আল্লাহ যদি আমাকে সুস্থ করে বাড়িতে নেয়, তখন যেন আমার ঘোড়াটিকে যারা মেরেছে তারা আসে। তাদের সঙ্গে একটি ছবি তুলে আমি তাদেরকে মাফ করে দিতে চাই।” বিষয়টি সবাইকে সেভাবেই জানিয়ে দেন রহিমা বেগম। ক্ষমা করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের মাধ্যমে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও মনু মিয়া আরেকবার তার মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। যেন এই পৃথিবীকে তিনি দু’হাত ভরে শুধু দিতেই এসেছেন, নিতে নয়।
মনু মিয়া শেষ ঠিকানার একজন নিপুণ কারিগর। মনের গহীনের পরম দরদ আর অপার ভালোবাসা দিয়ে তিনি সাজান মুসলিম সমপ্রদায়ের শেষ ঠিকানা- কবর। কারও মৃত্যুর সংবাদ কানে আসামাত্রই খুন্তি, কোদাল, ছুরি, করাত, দা, ছেনাসহ সহায়ক সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে যান কবরস্থানে। মানুষের অন্তিম যাত্রায় একান্ত সহযাত্রীর মতো তিনি বাড়িয়ে দেন তার আন্তরিক দু’হাত। এভাবেই কবর খননের কাজ করে তিনি পার করে দিয়েছেন তার ৬৭ বছরের জীবনের সুদীর্ঘ ৪৯টি বছর। কোনো ধরনের পারিশ্রমিক কিংবা বকশিশ না নিয়ে এ পর্যন্ত খনন করেছেন ৩ হাজার ৫৭টি কবর। ব্যতিক্রমী পন্থায় মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতার এক অনন্য প্রতীক হয়ে ওঠা মনু মিয়া কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর উপজেলা ইটনার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। একজন নিখুঁত সুদক্ষ গোরখোদক হিসেবে মনু মিয়ার সুনাম রয়েছে দুর্গম হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে। দূরের যাত্রায় দ্রুত পৌঁছাতে নিজের ধানীজমি বিক্রি করে বেশ কয়েক বছর আগে কিনেছিলেন ঘোড়াটিকে। আদর করে নাম দিয়েছিলেন, ‘বাহাদুর’। এই ঘোড়ার পিঠে তিনি তুলে নিতেন তার যাবতীয় হাতিয়ার-যন্ত্র। সেই ঘোড়ায় সওয়ার হয়েই শেষ ঠিকানা সাজাতে মনু মিয়া ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গ্রামে। ঘোড়াটিই যেন তার বয়সের বাধা অতিক্রম করে দিয়ে তাকে সচল রেখে চলেছিল। জীবনভর এ কাজটি করতে গিয়ে নিজের দিকেই খেয়াল নেয়া হয়নি তার। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা জটিল রোগ। রোগে কাবু হয়ে সম্প্রতি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। এ রকম পরিস্থিতিতে গত ১৪ই মে তাকে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসা চলছে নিঃসন্তান মানুষটির। স্ত্রী রহিমা বেগম স্বামীর পাশে রয়েছেন ছায়ার মতো। মনু মিয়ার সঙ্গে থাকা স্ত্রী রহিমা বেগম মোবাইল ফোনে মানবজমিনকে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতালের বেডে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় উনি (মনু মিয়া) হঠাৎ জেগে ওঠে অস্থিরভাবে বলতে থাকেন- আমার ঘোড়ার ঘুঙুরটা মনে হয় হারাইয়া গেছে। ঘুঙুরটা কই? পরের দিন শুক্রবার সকালেই ঘোড়াটিকে মেরে ফেলার খবর আমরা পাই। কিন্তু উনার শরীরের অবস্থা এতই খারাপ যে, আমরা খবরটি তাকে দেইনি। উনার পথের সাথী প্রিয় ঘোড়াটিকে আমরা হারিয়েছি, এটিই আমাদের জন্য অনেক বড় কষ্টের বিষয়। এই খবরটা দিলে উনি কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না। সোমবার সকালে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটলে তাকে বিষয়টি জানানো হয়।
পাঠকের মতামত
মনু মিয়ার মতো মহৎ ব্যক্তি আমাদের সমাজ বিনির্মাণের জন্য খুবই দরকার। আশা করি, রাষ্ট্র তার এ দু: সময়ে এগিয়ে আসবে।
সুস্থ হলে আবার ধানের জমি বিক্রি করে আরও একটি ঘোড়া কেনার আগেই অপরাধী কর্তৃক ক্ষতপৃরণ ও এলাকাবাসী মিলে একটি ঘোড়ার ব্যবস্থার আহবান জানাই।
মনু ভাইকে মনের মতো একটা ঘোড়া কিনে দিতে চাই।
ঘোড়াটি যারা মেরেছে তারা মানুষ না মানুষ নামের জানোয়ার পশু
আমরা মুসলমান তো দূরের কথা, মানুষ হিসেবে দাবি করতে পারি না। ছি ছি!!!
কী নিষ্ঠুর নির্মমতা! এই সংবাদ পাঠ করে কান্না চেপে রাখা সম্ভব নয়। বলার ভাষা নেই.......