নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
কোন্ পথে যাচ্ছে ট্রেন?
কাজল ঘোষ
২৪ মে ২০২৫, শনিবার
যমুনা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাদের যেকোনো দাবি নিয়েই ছুটছে যমুনায়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যমুনায় মার্চ করলেই দাবি মেনে নেয় সরকার। নিকট অতীতে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়া। কিন্তু কোনো কোনো দাবির পক্ষে আন্দোলনরতদের ঠাণ্ডা পানি আর কোনো কোনো দাবির পক্ষে গরম পানি দেয়ায় প্রশ্ন ওঠেছে সরকারের পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে। সবশেষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে সৃষ্ট আলোচনায় সামগ্রিক সংকট নিরসনে জাতীয় সরকার নিয়েও আলোচনা চলছে- এমনটাই বলাবলি আছে। দেশ আসলে কোন পথে এগুচ্ছে সামনের দিনগুলোতেই তা নির্ধারিত হয়ে যাবে
আলেফ মিয়া। তেজগাঁও এলাকায় রিকশা চালান। কাকরাইল, শাহবাগ, বাংলামোটর, মগবাজার এটুকুই তার সীমানা। ঘর্মাক্ত শরীরে ক্লান্তি নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন। এত বিরক্ত কেন? বলতেই, ‘আফনেই কন, আমরার তো আর চলে না। একটার পর একটা লাইগাই আছে। এহানে মিছিল। ওহানে রাস্তায় ব্যারিকেড। একটা দিনও মন মতোন গাড়িডারে চালাইতে পারতাছি না।’
আলেফ মিয়া নিজে গাড়ি চালাতে পারছেন না কিন্তু রাষ্ট্র নামক গাড়ি কি চলছে? গত ক’দিনের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও এন্তার খবর চাউর হয়েছে। রাজনীতিঘনিষ্ঠরা সামনের দিনগুলোতে চরম অনিশ্চয়তা দেখছেন। বলছেন, সংস্কারের ট্রেন কোথায় যাচ্ছে? কোন স্টেশনে আছে- এটাই ধোঁয়াশা। আর সংস্কার তো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ভালো নির্বাচনের জন্য খুব বেশি সংস্কারের প্রয়োজন নেই বলেও মনে করেন তারা।

ইতিমধ্যেই যমুনায় জল গড়িয়েছে অনেক। নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না আসা, সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ, মানবিক করিডোর, বন্দর নিয়ে সরকারের ঘোলাটে অবস্থান, মব ভায়োলেন্স অব্যাহত থাকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা। বুধবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত। মানবিক করিডোর, বন্দরের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোর সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের নেয়ার বিষয়ে তিনি মত দিয়েছেন। মব ভায়োলেন্স নিয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বিএনপি ইতিমধ্যেই নির্বাচন বিলম্বের প্রশ্ন তুলেছেন। দৃশ্যত, বিএনপি ও নতুন দল এনসিপি’র মধ্যে চলছে ঠাণ্ডা যুদ্ধ। দু’পক্ষই বেশক’জন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে।
বিএনপি, সরকারে থাকা দুজন ছাত্র উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অন্যদিকে এনসিপি তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে। বাইরে তীব্র সমালোচনা, অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার নেই এমন অনেক কাজে হাত দিয়েছেন বর্তমান উপদেষ্টা পর্ষদ। অথচ মূল কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন। সে বিষয়ে ‘রা’ নেই। যত দিন যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে ড. ইউনূসের। একমাত্র এনসিপি ছাড়া কারও সঙ্গেই পরিস্থিতি নিয়ে তিনি মুখোমুখি হননি। বিএনপি একাধিক বার প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চেয়েও পায়নি। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীও সর্বদলীয় বৈঠকের তাগিদ দিয়ে আসছে।
নানামুখী আলোচনার মধ্যেই, বৃহস্পতিবার মানবজমিন খবর প্রকাশ করে, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে চেয়েছেন। তার সামনে এর বিকল্প খুবই কম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসের নেতৃত্ব কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। তিনি অভ্যুত্থানের নায়কদের যমুনায় তলব করে বলেছেন, তোমরা সংযত হও নইলে আমি পদত্যাগ করবো। এ খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তামাম দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। কী হচ্ছে আসলে যমুনার ভেতরে? ড. ইউনূস এখন কী করবেন? যদি অতি দ্রুতই তিনি ট্রেন যথার্থ লাইনে না চালাতে পারেন তাহলে খেলা কোনদিকে মোড় নেবে।
পরিস্থিতি এতটা খারাপ হলো কী করে? ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, ৫ই আগস্টের পর থেকে এখনো পর্যন্ত সর্বত্র অস্থিরতা। যে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সূচিত হওয়ার কথা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে তা হয়নি। এখনো ‘মব ভায়োলেন্স’ অব্যাহত আছে। সবশেষ ধানমণ্ডিতে একজন প্রকাশককে হেনস্তা করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয় এবং পুলিশের দৃঢ় অবস্থানের কারণে জুলাই আন্দোলনে আহতরা সুচিকিৎসা পায়নি। তাদের পরিবার পরিজন রাস্তায় ঘুরছে ন্যায়বিচারের আশায়। সংস্কার নিয়ে সিরিজ বৈঠক চলছে। ঐকমত্য কমিশন এখনো স্পষ্ট করেনি কবে শেষ হবে এই প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক মহল থেকে বলা হচ্ছে, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ। এনসিপি এর ব্যতিক্রম।
করিডোর, বন্দর বিতর্ক:
বিতর্ক চলছে ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে। সরকারের দায়িত্বে থাকা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্পর্শকাতর এই বিষয় নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলছেন। নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান সবশেষ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তারা করিডোর নিয়ে আলোচনা করেননি এবং করবেন না। এই তিনিই বলেছেন, এ নিয়ে কে কি বললো, তাতে কিছু যায় আসে না। অথচ ‘করিডোরের’ মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাষ্ট্রের সকল স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে না বসেই এমন গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনা চলছে। সেনাপ্রধান স্পষ্টতই বলেছেন, করিডোর বা বন্দরের মতো ইস্যুতে জনগণের নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাধারণভাবেই প্রশ্ন জাগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজের ম্যান্ডেট কতোদূর? রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো নিয়ে কি আপৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
‘মব ভায়োলেন্সের’ শেষ কোথায়?
৫ই আগস্ট থেকে ৮ই আগস্ট সময়টা ছিল অস্থির। তখনো সরকার শপথ নেয়নি। দেশ জুড়ে বিচ্ছিন্ন অনেক হামলা, ভাঙচুর ও আগুনের খবর এসেছে। বেশ কিছু স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সেই সকল হামলাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সময়ের অত্যাচার আর নির্যাতনের কারণে ক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে এই মবক্রেসি বন্ধ হয়নি। একটি সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সকল নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, অপরাধীকে আইনের আওতায় নেয়া। অথচ মাঠে তার অনুপস্থিতি মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়েছে। একদিকে ট্রমাটাইজ পুলিশ আর অন্যদিকে মব ভায়োলেন্স পুরো শৃঙ্খলাকে টালমাটাল করে রেখেছে। নাগরিক মাত্রই এখনো নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় নির্বাচন, আগে কোনটি?
রাজনীতিতে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় নির্বাচন? বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ইশরাকের শপথ নেয়ার দাবিতে আন্দোলন চলাকালে এনসিপি নির্বাচন কমিশনের সামনে বিক্ষোভ করে দাবি জানায় আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম এবং প্রধান এজেন্ডা হচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন। আর তার জন্য বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়ার দাবি জারি রেখেছে। এনসিপি স্থানীয় নির্বাচন চেয়ে মাঠে নেমেছে। তারা সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত ইসিকে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। বিএনপি বলেছে, জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। ইতিমধ্যেই দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দু’মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। নইলে নতুন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামবে দলটি।
যমুনা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাদের যেকোনো দাবি নিয়েই ছুটছে যমুনায়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যমুনায় মার্চ করলেই দাবি মেনে নেয় সরকার। নিকট অতীতে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়া। কিন্তু কোনো কোনো দাবির পক্ষে আন্দোলনরতদের ঠাণ্ডা পানি আর কোনো কোনো দাবির পক্ষে গরম পানি দেয়ায় প্রশ্ন ওঠেছে সরকারের পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে। সবশেষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে সৃষ্ট আলোচনায় সামগ্রিক সংকট নিরসনে জাতীয় সরকার নিয়েও আলোচনা চলছে- এমনটাই বলাবলি আছে। দেশ আসলে কোন পথে এগুচ্ছে সামনের দিনগুলোতেই তা নির্ধারিত হয়ে যাবে। নেতিবাচকতার বাইরে দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নই আগে। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলে কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।