অনলাইন
১৯৫৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের ইতিহাস
মানবজমিন ডিজিটাল
(১ সপ্তাহ আগে) ২৪ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার, ৪:৩২ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:১১ পূর্বাহ্ন

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সরাসরি হামলা চালানোর নির্দেশ দেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইরান উত্তেজনা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ‘ধ্বংস’ করা হয়েছে। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরান এই অঞ্চলে আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। তারপর থেকে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এই অঞ্চলে ইরানের প্রক্সিদের সমর্থন এবং মার্কিন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আসা ইসরাইল গত সপ্তাহে ইরানের ওপর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ এনে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে।
ইসরাইলের দাবির কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ইসরাইলি হামলার পর ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে এনেছেন। এর মধ্যেই আমেরিকা ইরানে সরাসরি আঘাত হানে, যাকে ট্রাম্প প্রশাসন অত্যন্ত পরিশীলিত গোপন আক্রমণ বলে অভিহিত করেছে। এই হামলায় ১২৫টিরও বেশি মার্কিন বিমান এবং ৭৫টি বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল, যা নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। ওয়াশিংটন বলেছে যে, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে ‘ধ্বংস’ করেছে, তেহরান পাল্টা প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করে। ১৯৫৩ সাল থেকে মার্কিন-ইরান সম্পর্কের একটি সময়রেখা এখানে তুলে ধরা হলো-
১৯৫৩ সাল, মার্কিন-সমর্থিত অভ্যুত্থান এবং শাহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা
যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের উত্তেজনার সূচনা ঘটে ১৯৫৩ সালে, যখন ইরানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তেল জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। ১৯৫১ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বৃটিশ-নিয়ন্ত্রিত অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (বর্তমানে বিপি) জাতীয়করণ করেন। এতে ক্ষুব্ধ বৃটিশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চায়। এরপর যুক্তরাজ্যের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) এক গোপন অভিযানে অংশ নিয়ে অভ্যুত্থানে সহায়তা করে এবং পূর্বে অপসারিত রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানো হয়।
১৯৫৭ সাল, ‘অ্যাটমস ফর পিস’ ও পারমাণবিক সহায়তা
পারমাণবিক শক্তিধর ইরানের জন্য শাহের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন লাভ করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারের শান্তির জন্য পরমাণু কর্মসূচির অংশ হিসেবে উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তির বেসামরিক ব্যবহারের জন্য একটি পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এক দশক পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে একটি পারমাণবিক চুল্লি এবং জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম সরবরাহ করে। তখনকার এই পারমাণবিক সহযোগিতাই পরবর্তী সময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বর্তমান উত্তেজনার ভিত্তি গড়ে তোলে।
১৯৭৯ সাল, ইসলামী বিপ্লব
শাহ আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও ইরানে স্বৈরশাসন ও পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ জমতে থাকে। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে দেশে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন। একপর্যায়ে জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শাহ। এরপর নির্বাসনে থাকা ইসলামি চিন্তাবিদ আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি দেশে ফিরে এসে নেতৃত্ব দেন নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে।
১৯৮০ সাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে
শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায় ইরানি ছাত্রসমাজ। মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে ৫২ জন আমেরিকানকে ৪৪৪ দিনের জন্য অপহরণ করে তারা। ওয়াশিংটন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শাহ নির্বাসনে মারা যান।
১৯৮০-৮৮ সাল, ইরাকি আক্রমণকে সমর্থন করে আমেরিকা
খোমেনির আদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আগ্রহী ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের পক্ষে অবস্থান নেয়। যার ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও তীব্র হয়। যুদ্ধটি ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এবং উভয় পক্ষেই হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ইরাকও ইরানের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল।
১৯৮৪ সাল, সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক
লেবাননে একাধিক হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ইরানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সন্ত্রাসে মদদদাতা রাষ্ট্র’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন। ওই সময় লেবাননে ইসরায়েলের আগ্রাসনের পর যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলের সাথে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়ে। বেইরুতের এক সামরিক ঘাঁটিতে হামলায় ২৪১ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার জন্য ইরান-সমর্থিত লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে দায়ী করে। তবে পরে রেগান প্রশাসন হিজবুল্লাহর হাতে আটক মার্কিন জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে ইরানের সঙ্গে এক গোপন আলোচনা চালায়। এটি ‘ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত এবং তা রেগানের জন্য বড় এক রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
১৯৮৮ সাল, ইরান এয়ারের বিমান গুলি করে ভূপাতিত
ইরান-ইরাক যুদ্ধের উত্তেজনা এবং এমনকি উপসাগরে একে অপরের সামরিক যুদ্ধজাহাজের ওপর সরাসরি আক্রমণের মধ্যে একটি মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ ইরানের জলসীমা লঙ্ঘন করে এবং ৮ জুলাই দুবাইগামী বেসামরিক ইরান এয়ার ফ্লাইট (আইআর৬৫৫)-এ গুলি চালায়। এতে ২৯০ জন আরোহীর সকলেই নিহত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা এটিকে ভুল বলে দাবি করেছিল, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি বা দায় স্বীকার করেনি। তবে পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৬১.৮ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে।
১৯৯৫ সাল, কঠোর নিষেধাজ্ঞা
১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের নির্বাহী আদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে ইরানের সাথে লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে কংগ্রেস দেশটির জ্বালানি খাতে বিনিয়োগকারী বিদেশি সংস্থাগুলোকে বা ইরানের কাছে উন্নত অস্ত্র বিক্রিকারী বিদেশি সংস্থাগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে একটি আইন পাস করে। যুক্তরাষ্ট্র এসব পদক্ষেপের পেছনে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অগ্রগতি এবং হিজবুল্লাহ, হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের মতো গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থনের অভিযোগ তোলে।
২০০২ সাল, ৯/১১ এর পরবর্তী ঘটনা
যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ‘স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে ইরানকে ইরাক ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একত্রে ‘অ্যাক্সিস অব ইভিল’ বা ‘অশুভ জোট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অথচ ওই সময় আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ চালাচ্ছিল ছিল ইরান। এই সহযোগিতা ধাক্কা খায় বুশের বক্তব্যের পর। এরই মাঝে ২০০২ সালের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ইরানে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত করেন, যা তেহরানের বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞার পথ খুলে দেয়।
২০১৩ সাল, ইরান পারমাণবিক চুক্তি
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের সাথে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা শুরু করেন। ২০১৫ সালে তেহরান পারমাণবিক চুক্তিতে সম্মত হয়, যা আনুষ্ঠানিকভাবে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে পরিচিত, যা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিনিময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড সীমিত করবে।চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, যার ফলে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ৩.৬৭ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল।
২০১৮ সাল, ট্রাম্প পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসেন
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালে আমেরিকা একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে আসে এবং ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ট্রাম্প ও ইসরায়েল চুক্তির সমালোচনা করেছিল। ইরানও তার প্রতিশ্রুতি বাতিল করে এবং চুক্তিতে আরোপিত সীমার বাইরে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন শুরু করে।
২০২০ সাল, কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আমেরিকা বাগদাদে ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এর অভিজাত কুদস ফোর্সের প্রধান ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যা করে। এক বছর আগে প্রশাসন কুদস ফোর্সকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ইরান ইরাকে মার্কিন সম্পদের ওপর হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়।
২০২৫ সাল, তেহরানের কাছে চিঠি
চলতি বছর মার্চ মাসে ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে একটি চিঠি লিখে ৬০ দিন সময়সীমার মধ্যে পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে নতুন আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু খামেনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, আমেরিকা ইরানের সাথে আলোচনা করতে চাইছে না বরং তার উপর নিজেদের দাবি চাপিয়ে দিচ্ছে। ওমান ও ইতালিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু হয়েছিল, মাস্কাট মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। কয়েক দফা আলোচনার পর ট্রাম্প দাবি করেন যে তার দল একটি চুক্তির ‘খুব কাছাকাছি’ পৌঁছেছে এবং হামলার বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছেন। তেহরানও আশাবাদ ব্যক্ত করে। কিন্তু ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অধিকারের ওপর জোর দেয়-যা আলোচনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ইরান-মার্কিন আলোচনা ষষ্ঠ দফা শুরু হওয়ার একদিন আগে ইসরায়েল ইরান জুড়ে হামলা চালায়।
২০২৫ সাল, মার্কিন হামলা
নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার কথা উল্লেখ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। সূত্র: আলজাজিরা