ঢাকা, ৭ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

শরীর ও মন

মেডিটেশন কি এবং কেন?

আসিফ হাসান চৌধুরী
২১ মে ২০২৪, মঙ্গলবারmzamin

মেডিটেশন বা ধ্যান হলো আত্মনিমগ্ন হওয়ার প্রক্রিয়া। মেডিটেশন হচ্ছে একটি উপায় বা পথ; এটি কোনো লক্ষ্য নয়। প্রশ্ন আসতে পারে মেডিটেশন চর্চা কেন করব? ২১শে মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। দিবস উদ্‌যাপনের প্রাক্কালে মঙ্গল কামনা করছি জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের। মেডিটেশনের আলোয় সবার জীবনে বিরাজ করুক অনাবিল আনন্দ। 

মানুষের অন্তরে সর্বদা ভাবনা বা চিন্তার উদয় ঘটছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৭০,০০০ ভাবনার মুখোমুখি হয়। আপনি যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭ ঘণ্টা সময় ঘুমান তাহলে বাকি থাকে ১৭ ঘণ্টা। এই ১‌৭ ঘণ্টা সময়ের ব্যাপ্তিতে আপনি কম-বেশি ৭০ হাজার ভাবনা ভাবছেন। আবার ৭ ঘণ্টা সময় যে ঘুমাচ্ছেন, সেখানেও রক্ষা নেই। কিছু ভাবনা আপনার ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন হিসেবে দেখা দিচ্ছে বা প্রকাশ পাচ্ছে।

১৭ ঘণ্টায় ৭০ হাজার ভাবনার হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় ৪,১১৭টি ভাবনার মুখোমুখি হচ্ছেন আপনি। প্রতি মিনিটের হিসেবে ৬৮টি ভাবনা। অর্থাৎ প্রত্যেক মুহূর্তে একটি করে ভাবনা আমাদের অন্তর্জগৎ অতিক্রম করছে। অথচ আমরা এটি বুঝতেও পারি না। কারণ, আমরা এটি সম্পর্কে মোটেই সচেতন নই। 
কিন্তু আমরা সচেতন না হলে কি হবে ৭০ হাজার ভাবনার প্রতিটি ভাবনা অন্তরালে থেকে কোনো না কোনোভাবে আপনার আচরণকে প্রভাবিত করছে। অন্তর্জগতে তৈরি এই ভাবনা আপনার মনোযোগকে শুষে নিচ্ছে। ফলে আপনার আন্তর্জগতে কোনো শূন্যস্থান বিরাজ করছে না। একটার পর একটা চিন্তার স্রোতে আপনি অবিরাম ভেসে চলেছেন। মেডিটেশন চর্চার ফলে ভাবনার এই অবিরাম স্রোতের মধ্যে আমরা একটুখানি শূন্যস্থান তৈরি করছি।
একজন মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন মাথার মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া তার সকল ভাবনার স্রোতও থেমে যায়। একজন মৃত মানুষ চিন্তা করে না; একজন মৃত মানুষ চিন্তা করতে পারে না। চিন্তামুক্ত হওয়ার জন্য আমরা মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই না। সে কারণেই মেডিটেশন বা ধ্যান চর্চার গুরুত্ব এতো বেশি। 

মানুষ আসলে চিন্তা করে না বরং চিন্তা মানুষকে ব্যবহার করে। ভাবনা বা চিন্তার উপরে মানুষের আসলে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই চিন্তা যা ভাবায় মানুষ নির্বিচারে তা-ই ভাবে। চিন্তা যা করায় মানুষ নির্বিচারে তা-ই করে। মেডিটেশন বা ধ্যান শিক্ষা করে আমরা চিন্তা বা ভাবনার এই দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারি। 

কারণ আমরা যদি আমাদের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি শুধুমাত্র তাহলেই আমরা নিজেদের এবং মানুষের কল্যাণে চিন্তাকে ব্যবহার করতে পারবো। না হলে চিন্তা আমাদেরকে চিন্তার প্রয়োজনেই ব্যবহার করবে। আর চিন্তা যখন চিন্তার প্রয়োজনে মানুষকে ব্যবহার করে তখন একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটে। খবরের কাগজের পাতা খুললেই অথবা টেলিভিশনের নিউজ চ্যানেল খুললেই আমরা একটার পর একটা বিপর্যয়ের খবর দেখতে পাই।  
মানব সভ্যতার ইতিহাস হলো- বিপর্যয়ের ইতিহাস। মানুষ যখন তার মনের দাসত্ব করে তখন একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটে। তাই আমরা চিন্তার দাসত্ব করতে চাই না। আমরা আমাদের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। আমরা আমাদের ভাবনার প্রভু হতে চাই। আর সে কারণেই আমরা মেডিটেশন বা ধ্যান চর্চা করতে চাই। কারণ মেডিটেশন ছাড়া ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার আর কোনো উপায় নেই। 

এ নিয়ে গল্প আছে। একবার এক বিজ্ঞ পণ্ডিত (পণ্ডিত মানে যিনি অনেক জানেন) ভাবলেন যে, তিনি এতো কিছু জানেন কিন্তু মেডিটেশন বা ধ্যান করতে জানেন না। তার জানার ব্যাপ্তি আরও বাড়ানোর জন‍‍্য শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন তিনি ধ্যানের প্রক্রিয়াকে রপ্ত করবেন। তিনি ভাবলেন তার পক্ষে ধ্যানের প্রক্রিয়া রপ্ত করা ভীষণ রকম সহজ একটা ব্যাপার হবে। সেই বিজ্ঞ পণ্ডিত ধ্যান শেখার জন্য একজন সাধকের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং বললেন- ‘আমাকে দয়া করে ধ্যান শিক্ষা দান করুন। তিনি আরও বললেন, আমি যেহেতু একজন পণ্ডিত বা তত্ত্বজ্ঞানী আপনার পক্ষে আমাকে ধ্যান শেখানো খুব সহজ ব্যাপার হবে। সাধক খুব মন দিয়ে সেই বিজ্ঞ পণ্ডিতের সব কথা শুনছিলেন। সাধক বললেন, আপনি ধ্যান শিক্ষা করার জন্য এসেছেন; এতে আমি ভীষণ আনন্দ বোধ করছি। আসুন আমরা চা পান করি। ইতিমধ্যে চা প্রস্তুত করে তাদের সামনে দেওয়া হলো। এবার সাধক, বিজ্ঞ পণ্ডিতের কাপে চা ঢালতে আরম্ভ করলেন। ধীরে ধীরে কাপটি চা দিয়ে পরিপূর্ণ হলো। কিন্তু সাধক তখনও চা ঢেলেই চললেন। এদিকে সেই বিজ্ঞ পণ্ডিত চা উপচে পড়তে দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি বলে উঠলেন, কাপ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। চা উপচে পড়ছে। আর চা ঢালার প্রয়োজন নেই। তখন সাধক বললেন, আপনি যথার্থই বলেছেন। কাপ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। তাই চা উপচে পড়ছে। ঠিক একইভাবে আপনিও আপনার তত্ত্বজ্ঞান দিয়ে পরিপূর্ণ অবস্থায় বিরাজ করছেন। আপনার অন্তর্জগতে কোনো শূন্যস্থান নেই। তাহলে আপনাকে ধ্যান শেখাবো কী ভাবে? 

গল্পের শিক্ষা অত্যন্ত শক্তিশালী। আমরা যদি নিজেদের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো, আমরা প্রত্যেকেই স্ব-আরোপিত ধারণা, তথ্য এবং সংস্কার দিয়ে আগে থেকেই পরিপূর্ণ অবস্থায় বিরাজ করছি। আমাদের অন্তর্জগতে কোনো শূন্যস্থান বিরাজ করছে না। একটি পাত্র কখন সবচে বেশী উপযোগী হয়? যখন পাত্রটি খালি থাকে; শুধুমাত্র তখনই আপনি পাত্রটিকে কাজে লাগাতে পারবেন। মেডিটেশনে আমরা আত্মনিমগ্ন হয়ে নিজেদের অন্তর্জগতকে শূন্য করতে বা খালি করতে শিখি। যাতে করে মন অনাকাঙ্ক্ষিত সব বিষয় থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে পারে। এভাবে আমাদের মন সব ধরনের পুরোনো ধারণা, তথ্য, সংস্কার থেকে বিযুক্ত হয়ে সুস্থির হতে শেখে। প্রশ্ন করতে পারেন, মনকে সুস্থির করে কি হবে? 

মনকে ক্রমাগত সুস্থির করতে করতে, আমরা আত্মিক চেতনার সাথে সংযুক্ত হতে পারি। আত্মনিমগ্ন হয়ে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, আমরা আসলে চেতনার বিকশিত রূপ। আর আপনি যখন উপলব্ধি করবেন যে আপনি চেতনার বিকশিত রূপ; তখন প্রতিদিনের জীবনযাপনের কষ্ট বা যন্ত্রণা থেকে আপনি মুক্ত হতে পারবেন। তার অর্থ এই নয় যে, আপনার জীবনে চ্যালেঞ্জ থাকবে না। আপনার জীবনে সমস্যা থাকবে; কিন্তু কোনো কিছুই আপনার জীবনের সহজ স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তাকে রুদ্ধ করতে পারবে না। 

সে কারণেই জগতে যত মহাপুরুষ আবির্ভূত হয়েছেন তারা সবাই ধ্যান করতেন। আমাদের নবীজী (স.) ধ্যানমগ্ন হতেন। রাতের দীর্ঘ সময় তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। একবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তখন আয়াত নাজিল হয়েছিল, ‘হে চাদরাবৃত, ওঠো! (সুরা মুদাসসির ৭৪: ২-৭) ধ্যানের স্তরেই তার ওপর পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিল। তাই ধ্যানের প্রক্রিয়াকে জানতে হবে, ধ্যানমগ্ন হতে হবে, মেডিটেশন করতে হবে নিয়মিত।

 

লেখকঃ পিএইচডি; মলিকুলার বায়োলজি; গবেষক

শরীর ও মন থেকে আরও পড়ুন

শরীর ও মন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status