নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
এসব ঘটনার দায় কি সরকার এড়াতে পারে?
কাজল ঘোষ
২৬ মে ২০২৪, রবিবারএক্ষেত্রেও কথা থাকে তাহলে কি সরকারে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ব্যবস্থা এতটাই দুর্বল যে, দায়িত্বরতরা রাষ্ট্রের রক্ষক হওয়ার শপথ নিয়ে অবাধে ভক্ষণ করে গেছে আর তা দেখার কেউ নেই। অথবা যারা দায়িত্বশীল ছিলেন তারা দেখেও না দেখার ভান করেছেন বা শুনেও না শোনার ভান করেছেন। রংপুরের একটি আঞ্চলিক প্রবাদ মনে পড়ছে। প্রবাদটি হচ্ছে- ‘হচ হচাও খচ খচাও, ওপরত ছিটাও পানি, তোমার মনোত কী আছে, সেইডা আমি জানি।’ একেকটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে যে ধরনের কথা আমরা শুনি তাতে অবাক এবং বিস্মিত হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আমি যদি একটি পরিবারের প্রধান হই তাহলে আমার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে? তার খোঁজখবর কি আমি রাখবো না। অথবা যদি কোনো সন্তান ভুল পথে চলে যাই তার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবো না। তাহলে হয়তো এভাবে একজন আইনপ্রণেতাকে নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হতো না অথবা এমন একজন আইন প্রণেতার দায় সংসদকে নিতে হতো না
পত্রিকার পাতায় আটক এমপি আনার হত্যার আসামি কসাই জিহাদের বক্তব্য পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, মানুষ এতটা পাশবিক হয় কী করে? এতটা বর্বর হয় কী করে? স্বাভাবিকভাবেই একজন কসাই তার ভেতরে পাশবিকতা লালন করে, না হলে কসাই হবে কী করে? কিন্তু সবকিছুর পরও আমরা কসাইকে মানুষ ভাবি। কিন্তু জিহাদ নামক কসাই সেই ভাবনা-চিন্তার উপরে কালি লেপ্টে দিয়েছে। মানুষ হত্যার পর চামড়া আর মাংস আলাদা করা, মাংস দিয়ে কিমা করা, প্লাস্টিকে ভরে ফেলে দেয়া- এসব কী পড়ছি? এই খবরগুলো যখন শুনছি, পড়ছি তখন ভাবছি বাড়ি বাড়ি আমাদের ছোট ছোট শিশুরা রয়েছে, অনেক সংবেদনশীল মানুষ, পরিবার পরিজন রয়েছেন তাদের চোখে যদি এ ধরনের সংবাদ দৃশ্যমান হয় বা কাগজের এই খবরগুলো যদি আলোচনায় আসে তাহলে মনের অবস্থা কী হবে?
ভারতীয় মিডিয়ার বদৌলতে জিহাদের লোমহর্ষক এই বর্ণনায় মনে পড়ে ১৯৮৭ সালে ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিদারাবাদের সেই হত্যার ঘটনায় পুরো দেশ নড়েচড়ে বসেছিল। একই পাড়ার তাজুল ইসলাম গং শশাঙ্ক মণ্ডলের পরিবারের ছয় সদস্যকে রাতের আঁধারে নৃশংস কায়দায় হত্যা করে। যে হত্যার বর্ণনা এখনো মনে হলে স্তম্ভিত হয়ে যাই, এ-ও কি মানুষের পক্ষে সম্ভব? আনার হত্যার যে বর্ণনা কলকাতা পুলিশের বরাতে ঢাকার কাগজে প্রকাশিত হয়েছে তা কোনো সভ্য মানুষের কর্ম হতে পারে না।
গত কিছুদিন খবরের দুনিয়ায় তিনটি খবর- সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদ ও তার পরিবারের বিশাল সম্পত্তি জব্দের খবর, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং সবশেষ কলকাতার নিউটাউনে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা। তিনটি ঘটনার মোড়ক তিন রকম। দু’জন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থেকে সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে অনেক ঘটন- অঘটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। যে কারণে দু’জনই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছেন। আর একজন এমপি কতোটা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত তার ফিরিস্তি যত জানছি ততই বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ছে। আনারের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত অনেকের নাম আসছে। বলা হচ্ছে, যারা মাস্টারমাইন্ড এই হত্যার তার বাইরেও একাধিক প্রভাবশালী গডফাদার রয়েছে। পত্রিকার প্রতিদিনই খবর বের হচ্ছে, শত শত কোটি টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে এই হত্যা ঘটে থাকতে পারে। এর পেছনে রয়েছে স্বর্ণ চোরাচালান, অবৈধ পথে অর্থ পাচার, নারী, মদ, জুয়া, বাগানবাড়ি, জলসা কতো কিছু।
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, জেনারেল আজিজ ও আনারের ঘটনায় অস্বস্তি আছে সরকারি দলেও। তা নিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র আলোচনা। দলের সাধারণ সম্পাদক এ নিয়ে কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সঙ্গেও।
পরপর ঘটে যাওয়া আলোচিত এই তিনটি ঘটনা নিয়ে শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেবের বক্তব্যটি পুনরায় পাঠযোগ্য। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সে কী ছিল বড় কথা নয়, তার জনপ্রিয়তা দেখেই দল তাকে মনোনয়ন দিয়েছে।’
বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক সভায় ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্ন করে বলেন, আপনারা এখন বলছেন কলকাতায় তাকে চোরাকারবারি বলছে। আমি সাংবাদিকদের বলবো, তিন-তিনবার জাতীয় সংসদের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, তখন কি আপনারা এটা পেয়েছেন। এখন ভারতীয় সাংবাদিকরা কোন তথ্য আনলো, সেটার উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। আপনারা তো এই দেশের নাগরিক, সে যদি অপরাধী হয়, সেই অপরাধটা আপনাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে কেন এলো না।
একদিন পর শুক্রবার আবারো ওবায়দুল কাদের কথা বলেন, দুই পরাক্রমশালী ব্যক্তি সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ ও সেনাপ্রধানজেনারেল আজিজের সম্পত্তি জব্দ ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে। ওবায়দুল কাদের বলেন, বিচার বিভাগ ও দুদক স্বাধীন। সেখানে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে আমরা তাকে প্রটেক্ট (রক্ষা) করতে যাবো না, সে সাবেক আইজিপি বা সেনাপ্রধান হলেও। বিষয়টি দেখতে হবে, অপরাধী যত প্রভাবশালী হোক, প্রশ্ন থেকে যায় সরকার অপরাধের শাস্তি পাওয়ার ব্যাপারে সৎ সাহস দেখিয়েছে কিনা। শেখ হাসিনা সরকারের সে সৎ সাহস আছে।
একজন আমজনতা হিসেবে ওবায়দুল কাদের সাহেবের বক্তব্য থেকে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক করে-
দলের মনোনয়ন দেয়ার আগে প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার কথা শোনা যায়। নানান গোয়েন্দা রিপোর্টে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের বিষয়ে দলের সভাপতির কাছে রিপোর্ট পাঠানো হয়। এগুলো কি তাহলে বাত কি বাত? না হলে, একজন এমপি তিন তিনবার দলের এমপি হলেন, তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ। যার কেনোটাই সরকারি দলের মনোনয়ন বোর্ডের চোখে পড়লো না। যদি জনপ্রিয়তাই হয় মনোনয়নের মানদণ্ড তাহলে এ ধরনের দাগি অপরাধীও মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন? একজন সংসদ সদস্য যদি সরকার গঠনের অংশ হয়ে থাকে তাহলে তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায় ব্যক্তিগত এমনটা বলে সরকার বা দলের দায় এড়ানো ছাড়া আর কি যুক্তি থাকতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের এমপি’র অপরাধে অনুসন্ধানের প্রসঙ্গ এনেছেন। অনেক রিপোর্ট তো হয়েছে এমপি আনার ও তার গং নিয়ে। তাছাড়া ইন্টারপোলের অপরাধীদের তালিকায়ও তো আনারের নাম ছিল। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়েই অনেক অভিযোগ থেকে আনার নানাভাবে খালাস নিয়েছেন। সেই তথ্য তো পত্র-পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে। তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে সরকার একটি সর্বোচ্চ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তার রয়েছে একাধিক সংস্থা। তারা এই তিন টার্মে অর্থাৎ প্রায় পনেরো বছর এবং এর আগের সময়গুলোর এমপি আনারের অপরাধ জগৎ নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল? না হলে তো বলতে হবে সকলে মিলে একই সর্ষে।
দুই পরাক্রমশালী আলোচনায়। একজন পুলিশের বস। আর অন্যজন সুপ্রিম কমান্ডার। দুজনই এখন অবসরে। কিন্তু কথা হচ্ছে যে সকল অপরাধ বা দুর্নীতি আলোচনায় তার সবই সংঘটিত হয়েছে পদে আসীন থাকা অবস্থায়। আর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে সেসব কর্মকাণ্ডের উপর ভিত্তি করেই। অন্যদিকে যে বিশাল সম্পদের ফিরিস্তি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে, জব্দ করা হয়েছে তা-ও অর্জিত অফিশিয়াল পোশাকে দায়িত্বরত অবস্থাতেই। এক্ষেত্রেও কথা থাকে তাহলে কি সরকারে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ব্যবস্থা এতটাই দুর্বল যে, দায়িত্বরতরা রাষ্ট্রের রক্ষক হওয়ার শপথ নিয়ে অবাধে ভক্ষণ করে গেছে আর তা দেখার কেউ নেই। অথবা যারা দায়িত্বশীল ছিলেন তারা দেখেও না দেখার ভান করেছেন বা শুনেও না শোনার ভান করেছেন।
রংপুরের একটি আঞ্চলিক প্রবাদ মনে পড়ছে। প্রবাদটি হচ্ছে- ‘হচ হচাও খচ খচাও, ওপরত ছিটাও পানি, তোমার মনোত কী আছে, সেইডা আমি জানি।’
একেকটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে যে ধরনের কথা আমরা শুনি তাতে অবাক এবং বিস্মিত হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আমি যদি একটি পরিবারের প্রধান হই তাহলে আমার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে? তার খোঁজখবর কি আমি রাখবো না। অথবা যদি কোনো সন্তান ভুল পথে চলে যাই তার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবো না। তাহলে হয়তো এভাবে একজন আইনপ্রণেতাকে নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হতো না অথবা এমন একজন আইন প্রণেতার দায় সংসদকে নিতে হতো না।
শেষ করতে চাই প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমদের মানুষের নৃশংসতা নিয়ে একটি লেখার অংশ উল্লেখ করে। তিনি লিখেছেন, পত্রিকায় পড়লাম, এক মা তাঁর দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে পড়েছেন। এই মহিলা নিজে ঝাঁপ দিতে চাইলে ঝাঁপ দেবেন। অবোধ সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কেন?
স্বামীর সঙ্গে রাগ করে স্বামীকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এক মা সন্তান হত্যা করলেন। এই মা কেমন মা? আমেরিকার এক তরুণী মা তাঁর নয় মাস বয়সী সন্তানকে মাইক্রোওয়েভ চুলায় ঢুকিয়ে চুলা চালু করে হত্যা করলেন। হত্যাকাণ্ডে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। কী ভয়ঙ্কর!
বিড়ালকে নিজের সন্তান হত্যা করে খেয়ে ফেলতে আমি দেখেছি। বাঘও নাকি এ রকম করে।
আমরা কি বিড়াল এবং বাঘের উপর উঠতে পারিনি? এখনো পশু হয়ে আছি? জানি না, বর্তমান সময়ে কসাই জিহাদের এমপি আনারকে হত্যার বর্ণনা শুনে তিনি কী লিখতেন?
"আমি সাংবাদিকদের বলবো, তিন-তিনবার জাতীয় সংসদের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, তখন কি আপনারা এটা পেয়েছেন। এখন ভারতীয় সাংবাদিকরা কোন তথ্য আনলো, সেটার উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। আপনারা তো এই দেশের নাগরিক, সে যদি অপরাধী হয়, সেই অপরাধটা আপনাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে কেন এলো না।" এম পি নির্বাচিত হয়েছে কাদের ভোটে? জনগণ কি ভোট দিয়ে এম পি বানিয়েছে? জনগণের জন্য কোন ভোট আছে? জনগণ কি ভোট দিতে পারে? এসব ক কথা বলতে লজ্জা লাগে না?
এম পি আনার তার এলাকায় যে সব নাগরিক কে নির্মমভাবে হত্যা করেছে , সে বর্ননা প্রতিবেদনে নেই কেন ? সোহানকে নির্মমভাবে হত্যার কথা আরৈাচনায় নাই কেন ? আমি সকল হত্যাকান্ডের নিন্দা জানাই।