ঢাকা, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, রবিবার, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক

ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এর ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও প্রাকৃতিক প্রাচীর সুন্দরবনের সুরক্ষা করবে কে?

ড. মোহন কুমার দাশ
২৯ মে ২০২৪, বুধবারmzamin

বঙ্গোপসাগরে এপ্রিল ২০২৪-এ কোনো ধরনের লঘুচাপ তৈরি হয়নি। তীব্র দাবদাহ ছিল পুরো এশিয়া মহাদেশের বিরাট অংশ জুড়ে। সমুদ্রে ক্যাটাগরি-২ লেভেলের সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ ছিল। এপ্রিল পুরো মাস এবং মে মাসের একটা বড় সময় পর্যন্ত উত্তর ভারত মহাসাগরে কোনো ধরনের লঘুচাপ সৃষ্টি না হওয়া একটা বড় ব্যতিক্রম ঘটনা।

গত দুই দশকে (২০০৫ থেকে ২০২৪) মোট ১৬টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত করেছে। এর মধ্যে এপ্রিল মাসে দুইটি: বিজলি (২০০৯) এবং ফণি (২০১৯); মে মাসে নয়টি: আকাশ (২০০৭), আইলা (২০০৯), ভিয়ারু (২০১৩), রোয়ানু (২০১৬), মোরা (২০১৭), আম্ফান (২০২০), ইয়াস (২০২১), মখা (২০২৩) এবং রেমাল (২০২৪); জুলাই মাসে একটা: কোমেন (২০১৫); অক্টোবর মাসে তিনটা: রশ্মি (২০০৮), সিত্রাঙ (২০২২), হামুন (২০২৩); নভেম্বর মাসে তিনটা: সিডর (২০০৭); বুলবুল (২০১৯), মিধিলি (২০২৩)।

চলমান ঘূর্ণিঝড় রেমাল-এর সৃষ্টির প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। কিন্তু অগ্রসর হওয়া, এর গতিপথ, বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা এবং সুন্দরবনে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞ ২০০৯ সালের আইলার সঙ্গে মিল আছে। কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য জানা যাবে। রেমাল সৃষ্টির প্রথম ধাপ লঘুচাপের সম্ভাবনার মধ্যে ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৯শে মে ২০২৪ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু মালদ্বীপ এবং কমোরিন অঞ্চলের কিছু অংশ, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ আন্দামান সাগরের কিছু অংশে সক্রিয় হওয়া শুরু হয়। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় হওয়ার ঘটনা খুব বিরল।

মৌসুমি বায়ুর অগ্রগতির কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে যা লঘুচাপকে ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করে। এর মধ্যে ২২শে মে ২০২৪ দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ (Low Pressure) তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর ২৩শে মে সকাল ৯টায় সুস্পষ্ট লঘুচাপ সৃষ্টির বুলেটিন জারি করে। ইউরোপিয়ান গাণিতিক মডেল, ECMWF; ও আমেরিকান গাণিতিক মডেল, GFS এর পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছিল লঘুচাপটি আরও ঘনীভূত হয়ে ২৪শে মে ২০২৪ নিম্নচাপে ও পরে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। সে সময় সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২- ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ ছিল যা ঘূর্ণিঝড় গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ এবং আর্দ্রতার নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ দিচ্ছিল।

ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ মৌসুমি বায়ুকে তার নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে বৃষ্টিপাত বাড়িয়েছে। বিপরীত ভাবে, মৌসুমি বায়ু অতিরিক্ত আর্দ্রতা এবং শক্তি সরবরাহ করে ঘূর্ণিঝড় রেমালকে জ্বালানি সরবরাহ করেছে। অপেক্ষাকৃত উপকূল থেকে কম দূরত্বে সাইক্লোজেনেসিস হয়েছে খুব কম গতিতে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু জোয়ার, বাতাসের গতি এবং মৌসুমি বায়ু অত্যধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে মূল চালিকা শক্তির ভূমিকা রেখেছে। মৌসুমি বায়ুর দ্রুত অগ্রগতির লঘুচাপকে ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি বরং ভারী বৃষ্টি তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যা এখন চলমান।
পুরো সুন্দরবন এলাকা জুড়ে যে তাণ্ডব হয়েছে তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ খুব প্রয়োজন। প্রতিকার হিসেবে কী করা যেতে পারে, কতো দ্রুত করা যেতে পারে তার জন্য প্রস্তুতি দরকার। কিন্তু বাস্তবতা সবসময় ভিন্ন! আরেকটি সাইক্লোন ধারণ করার অবস্থা কী তার রয়েছে সেটার যথাযথ স্ট্যাডি দরকার।

নানাবিধ দূষণ, দখল, দুর্যোগ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে উচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন করছে। গত দেড় দশক ধরে প্রাক বর্ষা মৌসুমে আইলা (২০০৯), আম্ফান (২০২০) এবং রেমাল (২০২৪) এই তিনটি ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবন ঘেঁষে অতিক্রম করেছে এবং ব্যাপক ধ্বংস সাধন করেছে। অন্যদিকে বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে গত তিন দশকে সুন্দরবন কোনো না কোনো ভাবে ঢাল হিসেবে কাজ করে বুকে ধারণ করেছে ১৯৯৬, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০২, সিডর (২০০৭), রশ্মি (২০০৮), বুলবুল (২০১৯), সিত্রাঙ (২০২২) এবং মিধিলি (২০২৩) ঘূর্ণিঝড়গুলোকে।

অসংখ্য বার বনে আগুন লাগছে, মাছ ধরতে বিষ ব্যবহার করছে। বাঘ, হরিণ ও বন্য পশু শিকার, বন দখল, নদী দূষণ, বিভিন্ন নৌযান ডুবে যাওয়া, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, স্থাপনা নির্মাণ, পোল্ডার, বেড়িবাঁধ, চিংড়ি ঘের, হ্যাচারি, লবণাক্ততা প্রভৃতি এ বাস্তুসিস্টেমকে প্রতিনিয়ত হুমকিতে ফেলছে। নদী অভ্যন্তরে কার্গোর চলাচল, ট্যাংকার, জাহাজডুবি এগুলো ভয়ঙ্কর ঘটনা।

এপ্রিল, মে এবং অক্টোবর, নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের সময়। এটিকে বিবেচনায় রেখে পোল্ডার, বেড়িবাঁধ, যোগাযোগ অবকাঠামোর যথাযথ মেরামত করা বাঞ্ছনীয়। গত পনের বছরেও আইলার ক্ষত শুকায়নি! প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রাকৃতিক সুরক্ষার উদ্যোগ না নিলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ভয়ঙ্কর সময়ে প্রাকৃতিক প্রাচীর সুন্দরবন কীভাবে উপকূলবাসীকে সুরক্ষা দিবে?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড ম্যারিটাইম ইনস্টিটিউট (নোয়ামি) যুগ্ম সম্পাদক, সাউথ এশিয়ান মিটিওরোলোজিক্যাল এসোসিয়েশন (সামা)

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status