নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক
ব্যক্তি নয়, ব্যবস্থার পক্ষে ভারতের জনগণ রায় দিয়েছে
এম হুমায়ুন কবির
৬ জুন ২০২৪, বৃহস্পতিবারদক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে দু’টো মত পাওয়া যাচ্ছে। বিজেপি’র যারা আছে তারা বলছে- আমাদের যে নীতিগত অবস্থান আছে সেটা বজায় রাখবো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণভাবে সাম্প্রদায়িক এবং পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকে মাস্কুলার ফরেন পলিসি- এই দু’টো জিনিস করার জন্য সরকারের যে শক্তির জায়গাটা দরকার সে জায়গায় তাদের একটু চিন্তা করে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্ক পরিবর্তন হওয়ার মতো জায়গা আমি দেখছি না। যদি কংগ্রেস সরকার হয়, সেখানেও আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ২০০৯ সালে বাংলাদেশে বর্তমান সরকার আসার পরে কংগ্রেস সরকারকে পাওয়া গেছে কয়েক বছর ধরে। যেরকম সম্পর্ক ছিল মোদি আসার পরে সম্পর্ক একইরকম জায়গায় আছে
ভারতে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়ার সময় থেকেই কিন্তু মোদি ম্যাজিক তেমনভাবে দেখা যায়নি। মোদি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন, তবে সেটি খুব একটা মানুষ গ্রহণ করছে বলে মনে হয়নি। ৭ ধাপে নির্বাচনটা হয়েছে, প্রথম ধাপের পর থেকেই মনে হচ্ছিলো সেটা হয়নি। এর কয়েকটা ইন্ডিকেটর ছিল- মোদি ম্যাজিক যদি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতো তাহলে ভোটাররা বেশি সংখ্যায় ভোট দিতে আসতো। প্রথম থেকেই লক্ষ্য করা গেছে, এবার ভোটারদের উপস্থিতির সংখ্যা কম ছিল। তখন থেকেই পর্যবেক্ষকরা বলছিলেন, মানুষ ভোটের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। মোদি ম্যাজিক বা আকর্ষণটা তেমনভাবে কার্যকর ছিল না।
মানুষ নির্বাচনটাকে মোদির উপরে ম্যান্ডেড হিসেবে নিয়েছিলেন। বিজিপি’র যে মেনিফেস্টো সেখানে বলা হচ্ছিলো, মোদিকে ভোট দাও। বিজেপি ছাড়িয়ে কিন্তু মোদি নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন, মানুষের কাছে ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন। নির্বাচনের ফলাফলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, বিজেপি’র নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী মোদিকেই সরকার গঠনের একটা সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই নির্বাচনটা মোদির জন্য ভালো খবর নিয়ে আসেনি। আগে ২০১৯ সালে তার পার্লামেন্টে যে পরিমাণে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল এবার তা অনেক পরিমাণে কমে গেল। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, বিজেপি’র নেতৃত্বে এনডিএ ২৯৩ সংখ্যায় জোট হিসেবে আছে। এককভাবে বিজেপি ২৪০টি আসন পেয়েছে। ২৭২ সিটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার, এখন সরকার গঠন করতে হলে বিজেপিকে কিন্তু এনডিএ’র সমর্থন নিতে হবে। ২০১৯ সালে বিজেপি’র নিজেরই ২৭২ এর ওপর আসন ছিল। এনডিএ বা যারা শরিক আছেন তাদের ওপরে নির্ভরশীল হতে হয়নি। এবার ওদের ওপরে নির্ভরশীলতা বাড়বে।
২০১৯ সালের পরে মোদি প্রশাসন যেভাবে চালিয়েছে, সেখানে বেশির ভাগ সময়ে মোদির সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন সেটা একটু কঠিন হয়ে গেল। কারণ এখন একদিকে বিহারে জেডিইউ এবং অন্ধ্রের টিডিপি’র ওপরে নির্ভরশীল হতে হবে তাকে। মজার ব্যাপার, ৯০-এর দশকে দুই দলই বিজেপিতেও গেছে কংগ্রেসেও গেছে। তারা দুই দিকেই নাড়াচাড়া করে। হয়তো এখানে এনডিএ’র আওতায় থাকবে। চিন্তার বিষয়- তারা কংগ্রেসের সঙ্গে কথা বলবেন কিনা। কংগ্রেস ইতিমধ্যেই বলেছে, তারা কথা বলার চেষ্টা করবে। কংগ্রেস ইচ্ছা করলে যদি দু’টি দলের সমর্থন পায় তাহলে সরকার গঠন করতে পারে। এই দু’টি দল চাইলে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ২৭২ সিটের বেশি নিয়ে জোট গঠন করতে পারে।
মোদি প্রশাসনের চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে, একচ্ছত্রভাবে বিজেপি যে সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারতো এখন সেখানে জোটের প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটি আগের থেকে একটু জটিল হবে।
মোদি নিজেই নির্বাচনের প্রথম ধাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি সাম্প্রদায়িকতার পারদটাকে একটু উপরের দিকে তুলছিলেন। তার মুখ থেকে সাম্প্রদায়িক বক্তব্যগুলো সবাইকে চিন্তিত করেছে। তখনই আন্দাজ করা গেছিল, অভ্যন্তরীণভাবে তারা কি বুঝতে পারছে এখানে তাদের অবস্থাটা প্রত্যাশিত পর্যায়ের নিচে আছে। সেই কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিভাজনটা মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এই ফলাফলের মধ্যদিয়ে প্রথমত, ভারতীয় জনগণ সামগ্রিকভাবে সাম্প্রদায়িক গার্ড ব্যবহারটাকে পছন্দ করেনি। দ্বিতীয়ত, যেখানেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পটা বেশি সক্রিয় সেখানেই বিজেপি হেরে গেছে। বিজেপি’র যে লোকসানটা হয়েছে, তার বেশির ভাগই এসেছে উত্তর প্রদেশ থেকে। কারণ উত্তর প্রদেশেই ৮০টা আসনের মধ্যে প্রায় ৭২ থেকে ৭৩টা তাদের হাতে ছিল, এবার সেটা অনেক নিচে নেমে এসেছে। ইন্ডিয়া জোট অনেক বেশি পেয়েছে। বিশেষ করে ওখানকার সমাজবাদী পার্টি খুব ভালো ফলাফল করেছে।
অযোদ্ধার যেখানে বাবরি মসজিদ ১৯৯২ সালে ধ্বংস হয়েছে, সেখানে জানুয়ারি মাসে মোদি নিজে রামমন্দির উদ্বোধন করলেন। উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দু বা মেজরিটি কমিউনিটির সমর্থন আদায়ের জন্য একটা বাতাবরণ তৈরি করা। সেই অযোদ্ধাতেই কিন্তু বিজেপি’র প্রার্থী হেরে গেছেন। এটা খুবই চমকপ্রদ ছিল। হিন্দু কার্ড কাজে লাগেনি। উত্তর প্রদেশে তো লাগেইনি, সামগ্রিকভাবে ভারতেও মানুষের কাছে এই কার্ডটা আকর্ষণ করেনি।
এখানে ভারতের জনগণ শক্তিশালী ব্যক্তির চাইতে ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা প্রকাশ করেছে। এটা আজকে নয়, সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধীর সময়েও একই বিষয় ঘটেছিল। ইন্দিরা গান্ধী সাতাত্তরের নির্বাচনে গিয়ে হেরে যান। কংগ্রেস আজ পর্যন্ত তাদের যে দুর্গতি বা দুর্দশায় আছে সেটার জের সাতাত্তরের নির্বাচনের পর থেকে শুরু হয়েছে। ভারতীয় জনগণ একক শক্তিশালী নেতৃত্বের চাইতে ব্যবস্থার প্রতি যে তাদের আস্থা বেশি, এটা তারা প্রমাণ দিলো।
দ্বিতীয়ত, ভারতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি যে হুমকি তৈরি হয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ সংবিধান সংশোধনের একটা ভয় ছিল। যারা নিম্নবর্গের মানুষ আছে তাদের অধিকার হরণ করার একটা আশঙ্কা ছিল। ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি যে হুমকিটা ছিল এবারের নির্বাচনে জনগণ তাদের সক্রিয়তার মধ্যদিয়ে ভারতের সংবিধান এবং তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটাকে রক্ষা করেছে। আপাত হুমকিটা মোটামুটিভাবে থামিয়ে দেয়া হয়েছে।
নির্বাচনে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। তিনটা পক্ষের জয় আমি দেখি। যেহেতু তৃতীয়বার এনডিএ’র সমর্থনে মোদি আবার সরকার গঠন করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে তারা নিজেরা জয় দাবি করতে পারে। ২০১৯ সালের প্রেক্ষাপটে, ইন্ডিয়া জোট বা বিরোধী জোটও অসাধারণ ফলাফল করেছে। তাদের যে অবস্থা ছিল সেটা উতরে এসে এখন বিকল্প হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারছে, সেটা তাদেরও জয়। সবচেয়ে বড় জয় হয়েছে ভারতের ভোটারের। তাদের যে বক্তব্য আছে সেটাকে তারা শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করে ভারতের গণতন্ত্র রক্ষা করলেন। আমি মনে করি, তিন গ্রুপই জয়ী হয়েছে। যেহেতু ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক দেশ, গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য এটা একটা উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণার জায়গা হয়ে থাকলো বলে আমার ধারণা।
সরকার পরিচালনা আগে যেভাবে চলতো এখন ভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। মোদি নিজে যেভাবে গত ১০ বছর শাসন করেছেন, তার ধারাটার মধ্যে খানিকটা সংশোধন, পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের হয়তো প্রয়োজন হবে।
এমন অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে দু’টো মত পাওয়া যাচ্ছে। বিজেপি’র যারা আছে তারা বলছে- আমাদের যে নীতিগত অবস্থান আছে সেটা বজায় রাখবো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণভাবে সাম্প্রদায়িক এবং পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকে মাস্কুলার ফরেন পলিসি- এই দু’টো জিনিস করার জন্য সরকারের যে শক্তির জায়গাটা দরকার সে জায়গায় তাদের একটু চিন্তা করে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্ক পরিবর্তন হওয়ার মতো জায়গা আমি দেখছি না। যদি কংগ্রেস সরকার হয়, সেখানেও আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ২০০৯ সালে বাংলাদেশে বর্তমান সরকার আসার পরে কংগ্রেস সরকারকে পাওয়া গেছে কয়েক বছর ধরে। যেরকম সম্পর্ক ছিল মোদি আসার পরে সম্পর্ক একইরকম জায়গায় আছে। তবে মালদ্বীপ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পররাষ্ট্রনীতিগত অবস্থানে একটুখানি পরিবর্তন করেছে। সেখানে ভারত যেটুকু চাপ দিতে পারতো সেটা নিয়ে হয়তো আরেকটু সচেতনভাবে চিন্তা করতে হবে। ভারতের দলগুলোকে এখন অভ্যন্তরীণভাবে আরও মনোযোগী হতে হবে। সেক্ষেত্রে আমার ধারণা, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে সক্রিয়তা ছিল সেটা হয়তো খানিকটা কম হলেও হতে পারে।
বিজেপি ওড়িশা ও বিহারে খুবই ভালো ফলাফল করেছে। ত্রিপুরা ও আসামেও বিজেপি ভালো করেছে। সেই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গে তারা শুধু নিজেদের সুরক্ষাই দেয়নি বরঞ্চ বিজেপিকে ওখান থেকে সরিয়ে মমতা ব্যানার্জীর দল ৪২টা আসনের মধ্যে ২৯টা আসনেই কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। এটা মমতার জন্য খুবই ভালো খবর।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক