নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক
ভারতের লোকসভা নির্বাচন, কিছু প্রত্যাশিত, কিছু চমক
মো. তৌহিদ হোসেন
৮ জুন ২০২৪, শনিবারভারতের পররাষ্ট্র সচিব এসেছিলেন কিছুদিন আগে সংক্ষিপ্ত সফরে। তিনি এসেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণ হস্তান্তর করতে, ঠিক প্রস্তুতিমূলক কোনো আলোচনা করতে নয়। প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে হয়তো কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ এমওইউ সই হতে পারে দৃশ্যমানতা দেয়ার জন্য। এই সফর, দু’দেশের সরকারেরই নতুন মেয়াদে প্রবেশ উপলক্ষে একটি সৌজন্য সফরের রূপলাভের সম্ভাবনাই বেশি। যদি কোনো সমস্যা সমাধানে প্রকৃত অগ্রগতি হয়, যেমন তিস্তা বা সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশের মানুষ তাকে সানন্দে স্বাগত জানাবে
ছয় সপ্তাহব্যাপী সাত দফায় ২০২৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচন শেষ হলো ১লা জুন, ফলাফল ঘোষিত হলো ৪ঠা জুন। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ২৪০ আসন পেয়ে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭২ আসনের চেয়ে তা ৩২টি কম। এনডিএ জোটসঙ্গীদেরসহ মোট প্রাপ্ত আসন ২৯৩। জোটসঙ্গীরা এরই মাঝে মোদির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তিনি তাই তৃতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিচ্ছেন। ৯ই জুন শপথ অনুষ্ঠানের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিথি হবেন এই অনুষ্ঠানে। নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩২টি আসন, এককভাবে কংগ্রেস ৯৯টি।
এই ফল কি প্রত্যাশিত ছিল? নাকি এটি বড় কোনো চমক? নির্বাচনী প্রচারণায় মোদি এবং বিজেপি চারশ’ আসনের গল্প করছিলেন। আর ভারতীয় মিডিয়াতে অনেকটাই তার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিলো।
বুথ-ফেরত জরিপেও প্রায় সব নির্বাচন-বিশেষজ্ঞ একমত ছিলেন যে, ৪০০ না হলেও ৩৫০ আসন যাচ্ছে মোদির ঝুলিতে। এর সবই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ১৩ই মে ঢাকায় কর্মরত পূর্ব এশীয় একটি দেশের রাষ্ট্রদূত ভারতের নির্বাচন নিয়ে তিনটি বিষয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তার একটি ছিল, বিজেপি কি সত্যিই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে? উত্তরে আমি তাকে যে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম তা বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘বিজেপি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এটা আমার কাছে অতিপ্রত্যাশা বলে মনে হয়।
বিজেপি বড়জোর যেটা আশা করতে পারে তা হচ্ছে একটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, বা হয়তো জোটসঙ্গীদের সমর্থন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এক, মোদি যদিও তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, লোকসভায় গত ১০ বছরব্যাপী বিজেপি এবং জোটের একাধিপত্যের অবসান হচ্ছে। সংসদে একটি বাস্তব বিরোধী দল থাকছে যাদের কণ্ঠস্বরও এখন থেকে শোনা যাবে। দুই, ২০১৪ সালের নির্বাচনী ফলাফলে চরম অপদস্ত কংগ্রেস দল ১০ বছরের নিভু নিভু অবস্থা থেকে আবার মূলধারায় ফিরে এসেছে। গত দু’টি লোকসভায় কোনো স্বীকৃত বিরোধী দল ছিল না, কারণ এজন্য প্রয়োজনীয় ৫৫টি আসন লাভেও ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। ৯৯টি আসন নিয়ে কংগ্রেস এবার স্বীকৃত বিরোধী দল হিসেবে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকবে। ভারতের ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের জন্য দু’টি বিষয়ই সুসংবাদ।
উত্তর প্রদেশে বিজেপি’র ফল বিপর্যয় (৮০ আসনের মাঝে ৩৩, গতবারের তুলনায় ২৯টি কম) সার্বিকভাবে বিজেপি’র জন্য একটি ধাক্কা হিসেবে এসেছে। এত ঘটা করে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের পরও সেই আসনেও বিজেপি হেরে গেছে। বারানসি থেকে জিতেছেন মোদি, কিন্তু ভোট পেয়েছেন ২০১৯ এর চেয়ে কম। পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় মিডিয়ার প্রচারণাকে হাস্যকর প্রমাণ করে বিজেপির আসন কমে ১৮ থেকে ১২টিতে নেমে গেছে।
আপাতদৃষ্টিতে বিজেপি’র আসনসংখ্যা ৩০৩ থেকে ২৪০ এ নেমে আসা এবং কংগ্রেসের ৫২ থেকে ৯৯ আসনে উল্লম্ফন, সেইসঙ্গে ১০ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে এককভাবে ভারত শাসনের পর সরকার গঠনে মোদির জোটসঙ্গীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়াকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরাজয় এবং উদারনৈতিকতার একপ্রকার বিজয় বলে মনে করছেন অনেকেই। নয়াদিল্লি থেকে অঞ্জলি মোদি এমনো লিখেছেন যে ‘ভারতের ভোটাররা অবশেষে জেগে উঠছেন’ (প্রথম আলো, ৬ই জুন ২০২৪)।
খানিকটা হয়তো তাই, কিন্তু আরেকটু যদি গভীরে প্রবেশ করা হয় তাহলে একটি ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। আঞ্চলিকভাবে হয়তো কিছু কিছু মেরুকরণ ঘটেছে, কিন্তু সর্বভারতীয় পর্যায়ে ২০১৯ এর তুলনায় বিজেপি’র ভোট কমেছে মাত্রই শতকরা ০.৮ ভাগ (৩৬.৫৬% বনাম ৩৭.৩৬%)। ক্ষমতাসীনদের ওপর স্বাভাবিক অসন্তোষ, যাকে এন্টি ইঙ্কাম্বেন্সী ফ্যাক্টর বলা হয়, সে কারণেই এটুকু, এমনকি আরেকটু বেশিও তফাৎ হতে পারতো। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভোটারদের মাঝে বিজেপি’র সার্বিক প্রভাব হ্রাস অতি সামান্য। পক্ষান্তরে, প্রথম বারের মতো বিজেপি কেরালায় একটি আসন দখল করেছে। তামিল নাড়ুতে একটিও আসন পায়নি যদিও, প্রাপ্ত ভোট বেড়েছে অনেক। একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত ওডিসা বিধান সভা নির্বাচনে ১৪৭ আসনের মাঝে ৭৮টিতে বিজয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো এ রাজ্যে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বিজেপি।
একইভাবে, ২০২৪ এর নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রাপ্ত ২১.১৯ শতাংশ ভোট তাদের ২০১৯ এর বিপর্যয়কর ফলের তুলনায় ১.৭ শতাংশ বেশি। এটি একেবারে কম নয়, কিন্তু ৫২ আসনের তুলনায় ৯৯ যে ইঙ্গিত দেয়, তাকে প্রতিফলিত করে না। সব মিলিয়ে এটুকু বলা যায় লোকসভায় আসন লাভে যদিও ব্যাপক হ্রাস বৃদ্ধি হয়েছে, জনসমর্থনে পরিবর্তন সে তুলনায় তেমন স্পষ্ট নয়। দুই দলই নিশ্চয় এখন পরিকল্পনা শুরু করবে পাঁচ বছর পর ২০২৯ এর নির্বাচনের জন্য কি কি রণকৌশল তারা নির্ধারণ করবে।
ভারতের এই নির্বাচনী ফল কি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে? এক কথায় বলতে গেলে, আমার তা মনে হয় না। দুই দেশের কোথাও সরকার পরিবর্তন হয়নি, আর দুই দেশের নেতৃত্বই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে পুনঃপুনঃ সন্তোষ ব্যক্ত করে আসছেন। সেক্ষেত্রে এই সম্পর্কে পরিবর্তন আনার প্রয়োজনটা কোথায়? বাংলাদেশের চাওয়া পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু ঘটবে কিনা সে প্রশ্নও উঠছে। যেহেতু বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়গুলোর সমাধান না করেই ভারত তার স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে, আমি মনে করি না যে এ বিষয়গুলোর আশু সমাধানের কোনো সম্ভাবনা আছে।
জুন মাসের শেষ দিকে বা জুলাইয়ের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ভারত যাবার সম্ভাবনা দ্বিপক্ষীয় সফরে। কোনো জট খুলবে কি এই সফরে? পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম ছাড়া শীর্ষ বৈঠকে বড় কোনো সিদ্ধান্ত সাধারণত হয় না। এমন কোনো দ্বিপক্ষীয় কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়েনি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এসেছিলেন কিছুদিন আগে সংক্ষিপ্ত সফরে। তিনি এসেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণ হস্তান্তর করতে, ঠিক প্রস্তুতিমূলক কোনো আলোচনা করতে নয়। প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে হয়তো কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ এমওইউ সই হতে পারে দৃশ্যমানতা দেয়ার জন্য। এই সফর, দু’দেশের সরকারেরই নতুন মেয়াদে প্রবেশ উপলক্ষে একটি সৌজন্য সফরের রূপলাভের সম্ভাবনাই বেশি। যদি কোনো সমস্যা সমাধানে প্রকৃত অগ্রগতি হয়, যেমন তিস্তা বা সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশের মানুষ তাকে সানন্দে স্বাগত জানাবে।
লেখক- সাবেক পররাষ্ট্র সচিব