নির্বাচিত কলাম
বিরোধী দলের রাজনীতি
বাংলাদেশ ও ভারতের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
সাজ্জাদ নাঈম
২৬ জুন ২০২৪, বুধবারবিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত সুপরিচিত। কিছুদিন আগেই দেশটিতে সাত দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এনডিএ জোটের সরকার গঠন আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক ঘটনা মনে হলেও এর প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতে তো বটেই সার্বিক গণতান্ত্রিক চর্চায় এই নির্বাচনের ফলাফলের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর এবং এর অভিঘাত দীর্ঘদিন থাকবে বলেই আশা করা যায়। এই রচনার অভিমুখ মূলত দুই দিকে- একদিকে ভারতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতির সংক্ষিপ্ত আলোচনা অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরোধী দলের রাজনীতির গতিপথ বিশ্লেষণ।
কংগ্রেসের হালহকিকত (২০১৪-২০২৪): ভারতের শতবর্ষের প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, দল ও দেশের দায়িত্ব দীর্ঘ সময়ের জন্য ছিল নেহরু-গান্ধী পরিবারের হাতেই। এর মাঝে ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীর হাত ধরে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তা বেশ কিছু সময়ের জন্য এই নেহরু-গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বের পরম্পরায় ছেদ পড়ে এবং এমনকি এসময় প্রথমবারের মতো হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি অটল বিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। যদিও, ২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট সরকার গঠন করে এবং দলের নেতৃত্বে পুনরায় সোনিয়া গান্ধীর হাত ধরে গান্ধী পরিবার আসীন হয়। এরপর, ২০১৪ সালের নির্বাচনে, কংগ্রেসের দুর্নীতি এবং মোদির গুজরাট মডেলের জোয়ারে বিজেপি সরকার গঠন করে এসময় ইউপিএ জোট জয়লাভ করে ৬০টি আসনে। এরমধ্যে কংগ্রেস জয়লাভ করে ৪৪টি আসনে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদের প্রভাবে বিজেপি পুনরায় সরকার গঠন করে এবং ইউপিএ জোট জয়লাভ করে ৯১টি আসনে। এরমধ্যে কংগ্রেস জয়লাভ করে ৫২টি আসনে। তবে এবারের ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি সরকার গঠন করলেও এবার
অধুনাপ্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়া জোট ২৩৪টি আসনে জয়লাভ করে। এরমধ্যে কংগ্রেস ১০১টি আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে বিরোধীদের সাফল্যই মূলত এই অংশের আলোচনার বিষয়।
২০১৪ এবং ২০১৯ এই দুই মেয়াদে বিজেপি’র জয়লাভের পর থেকে কট্টর হিন্দুত্ববাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান, ধর্ম ও জাতপাতভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, ধনিক শ্রেণির তোষণ, বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার, দুজন মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার, সংসদ থেকে বিরোধী দলের সদস্যদের বহিষ্কার, ইলেক্টোরাল বন্ডের কেলেঙ্কারি, বিরোধী মতের নেতাদের দমনে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়। এসময় কালে কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন না করা, মূলধারার মিডিয়ায় কেবল সরকার বন্দনা, ছাত্র আন্দোলনের ওপর হামলা, শাহিনবাগ আন্দোলনের ওপর হামলা, বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি ব্যতীত অন্যদলের সরকার থাকলে সেখান থেকে এমএলএ বের করে নিয়ে এসে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো বা পতন ঘটানোর চেষ্টা করা, মহারাষ্ট্র বা মধ্য প্রদেশ এর উদাহরণ, CAA, NRC মতো বৈষম্যমূলক নীতি প্রণয়ন করা, যে সমস্ত রাজ্যে বিজেপি’র সরকার প্রতিষ্ঠিত সে সমস্ত রাজ্যের মুসলমানদের ওপর ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা, বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির স্থাপন করা, এরকম আরও কিছু জায়গায় মসজিদ ভেঙে মন্দির প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় শুরু করা হয়। অর্থাৎ, এসময়ে ভারতীয় রাজনীতির পরিমণ্ডলে যে উদারনীতির চর্চা, সংখ্যালঘু এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ, সকল মত ও পথের প্রতি সম্মান, সকলের মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় উদারপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর জনবিচ্ছিন্নতার কারণে। বিশেষত কংগ্রেসের মতো জাতীয় এবং সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সংকট, সাংগঠনিক দুর্বলতা, সময়োচিত কৌশল প্রণয়নে ব্যর্থতার কারণে উদারপন্থিদের মনে হতাশার সৃষ্টি হয় এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক চর্চা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরকম এক পরিস্থিতিতে, কীভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সাফল্য অর্জন করে তা আলোচনার দাবি রাখে।
এই সাফল্যের জন্য অনেকাংশেই কৃতিত্ব রাহুল গান্ধীর যিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর কংগ্রেসের সভাপতির (২০১৭-২০১৯) পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং সরকারি দল এবং মিডিয়ার কটাক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। তবে এসময় তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যাতে তার এবং তার দলের লড়াকু ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা দেখবো তিনি ভারত জুড়ে দুটি দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। একটি ছিল ১৫০ দিনব্যাপী “ভারত জোড় যাত্রা”। এই পদযাত্রা শুরু হয় তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে এবং প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই যাত্রা শেষ হয় কাশ্মীরের শ্রীনগরে গিয়ে। অন্যটি ছিল “ভারত জোড় ন্যায় যাত্রা”। ৬৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই যাত্রা শুরু হয় মণিপুর থেকে এবং শেষ হয় মুম্বইয়ে। এই যাত্রা শুরু হয় এই দুটি পদযাত্রার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন পর্যায়ের, বিভিন্ন পেশার জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা, তাদের সঙ্গে কথা বলা, একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করা- সর্বোপরি দলকে বিভিন্ন রাজ্য স্তরে চাঙ্গা করা। একই সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের সিভিল সোসাইটির সদস্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। এই দুটি পদযাত্রা ছাড়াও রাহুল গান্ধী নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পেশার মানুষের (কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ট্রাক ড্রাইভার, ফুড ডেলিভারি ম্যান, গ্রামের সেলুনের নাপিত, সাবেক সেনাসদস্য) সঙ্গে অবস্থান করে তাদের পেশাগত সুবিধা- অসুবিধার কথা জানার চেষ্টা করতেন যার প্রকাশ ঘটে কংগ্রেসের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে। রাহুল গান্ধীর প্রচারণার আরেক দিক হচ্ছে বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, ধনী-দরিদ্র্যের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং মুসলমান সহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা অর্থাৎ, বিজেপি’র ধর্ম ও জাতপাতের বিভাজনের রাজনীতির বিপরীতে তিনি জনগণের জীবনধারণের সঙ্গে জড়িত সমস্যাকেই নির্বাচনী রাজনীতির এজেন্ডায় পরিণত করেছিলেন। তিনি একই সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের সমমনা দলগুলো নিয়ে “ইন্ডিয়া” নামের শক্তিশালী বিরোধী জোট গড়ে তুলেন। যার প্রভাব লোকসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলোতে দেখা গেছে। অর্থাৎ, সমাজের পিছিয়ে পড়া, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন, জনসমস্যাকে গুরুত্ব দেয়া এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের জোট তৈরি করা, এসবই ছিল দেশের মানুষের কাছে রাহুল গান্ধীর নিজের এবং কংগ্রেসের ইমেজ পুনঃনির্মাণ করার প্রক্রিয়া।
এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, তাহলো নিয়মিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ এমনকি, সফল দুটি পদযাত্রার পর কর্ণাটক বাদে ছত্তিসগড়, মধ্য প্রদেশ এবং রাজস্থানের বিধান সভা নির্বাচনে হেরে গেলেও লোকসভা নির্বাচনে পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে ক্রমাগত প্রচারণা চালানো এবং লোকসভা নির্বাচনে সরকার গঠন করতে না পারলেও বিরোধী দলের দায়িত্ব পজিটিভ ভাবে পালনের চেষ্টা করা।
বাংলাদেশের বিরোধী দলের রাজনীতি: এবার বাংলাদেশের দিকে লক্ষ্য করা যাক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে গণতান্ত্রিক চেতনা চর্চা এবং প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আছে এবং এই সংগ্রামের সফলতার ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে বহু দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিভিন্ন ঘটনার পথ পরিক্রমায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ২০০৯ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। ২০১৪ সাল থেকে এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয় এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় যা ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪-এর নির্বাচনে বলবৎ ছিল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না এই যুক্তিতে দেশের প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো দু’টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই এবং ২০১৪ সাল থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছে। কিন্তু সরকার তার আগের অবস্থানেই অটল আছে এবং দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজন করছে। যেহেতু বিরোধী দল অংশগ্রহণ করছে না, তাই নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে না, জনগণ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না এতে করে জনগণের কাছে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি প্রকটিত হচ্ছে, যা সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এক্ষেত্রে আমাদের দেখতে হবে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলো বিশেষত বিএনপি কি কৌশল অবলম্বন করছে এবং এর সঙ্গে ভারতের বিরোধী দলগুলোর মৌলিক পার্থক্য কোথায়?
ভারত এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ প্রায় একই রকম, পরিবারতান্ত্রিক, এখানে বিরোধী দলের মুখ বিএনপি’র ভাইস চেয়ারপারসন তারেক রহমান যিনি দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশে অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা চলছে; দলের চেয়ারপারসন অনেকদিন কারারুদ্ধ ছিলেন, যেহেতু শারীরিকভাবে অনেকদিন ধরেই অসুস্থ; তাই সরকার তাকে শর্তসাপেক্ষে বাসায় থেকে চিকিৎসা করার অনুমতি দিয়েছে। তাই এরকম এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে যেখানে একদিকে সরকার এতটাই শক্তিশালী যে, তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরানো একরকম কঠিন অন্যদিকে সক্রিয় রাজনীতিতে বিএনপি’র দুই শীর্ষ নেতা শারীরিকভাবে অনুপস্থিত; এমতাবস্থায় কেমন চলছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র রাজনীতি?
এরকম এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কৌশলেও নতুনত্ব প্রয়োজন। কিন্তু এধরনের কৌশলের অনুপস্থিতি প্রকট। ২০১৪ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও এই আন্দোলন গত ১০ বছরেও সফল হয় নাই। আন্দোলনগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এসব আন্দোলনে তাদের দাবির সঙ্গে জনগণ একমত থাকলেও, জনগণকে তারা এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারে নাই। নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে এধরনের মৌলিক প্রশ্নে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের ধরন কেমন হতে পারে সেটা নির্ধারণ করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া শীর্ষ দুই নেতার শারীরিক অনুপস্থিতি এই ধরনের আন্দোলনে সফলতার সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যায়।
অন্যদিকে জনগণ এবং দেশের অর্থনীতি নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও জনগণের এসব সমস্যা নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে কোনো ধারাবাহিক আন্দোলন তৈরি করতে কোনো উদ্যোগ এবং আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। জনগণের সমস্যা নিয়ে তারা খুব একটা সোচ্চার না। অথচ, জনগণের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনের করার মধ্যদিয়ে জনগণের সঙ্গে তারা সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এবং জনকল্যাণে অহিংস কর্মসূচির মধ্যদিয়ে তারা মূল আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগের পথও খুঁজে বের করতে পারতো। অন্যদিকে ভারতের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিজেপি’র ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপরীতে, ভারতের বিরোধী দলগুলো জনগণের সমস্যা নিয়ে ক্রমাগত আন্দোলন করে জনগণের ইস্যুকেই নির্বাচনের মূল এজেন্ডায় পরিণত করেছিল।
আমাদের বিরোধী দল বিশেষত বিএনপি’র রাজনৈতিক পদক্ষেপসমূহ বিশ্লেষণ করলে মনে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ইস্যুতে তারা অনেক বেশি বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তারা মনে করে বিশেষ কোনো বিদেশি শক্তি তাদেরকে সরাসরি ক্ষমতায় নিয়ে যাবে, এতে করে যেটা হচ্ছে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপরেখা কেমন হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা কম হচ্ছে। জনগণের ইস্যুতে আন্দোলনের আগ্রহ কমে যাচ্ছে, জনসম্পৃক্ততা তৈরির প্রবণতা কমে যাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো দেশই অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি জড়িত হবে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের অন্যতম সেরা উপায়। যার ব্যবহার দেখা গিয়েছে রাহুল গান্ধীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত এবং সরব উপস্থিতি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের ভরাডুবির পর কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হয় এবং অন্যান্য কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সঙ্গেও যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দল এবং নেতাদের ব্যক্তিগত উপস্থিতি খুব একটা দেখা যায় না। কনটেন্ট নির্মাতাদের সংখ্যাও খুব একটা বেশি না এবং নির্মাণের ক্ষেত্রেও খুব একটা নতুনত্ব দেখা যায় না।
এদিকে জোট গঠনের ক্ষেত্রে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। বাংলাদেশে বিরোধী জোটে বিএনপি বাদে তৃণমূল পর্যায়ে অন্যদলগুলোর সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না। গতানুগতিক জোট তৈরি করলে এক পর্যায়ে তা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জোট কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে নতুন করে ভাবা উচিত। ভারতের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি আলাদা। কেননা, সেখানে রাজ্য স্তরের অনেক দল কংগ্রেসের চেয়েও শক্তিশালী যেমন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস বা মহারাষ্ট্রের শিবসেনা ইত্যাদি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্র্ণ হচ্ছে, বাংলদেশের বিরোধী দলগুলোর কাছে গণমুখী ন্যারেটিভের অভাব আছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হলে জনগণের জন্য ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে। জনগণ নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃস্থাপনের ভাষ্যে খুব একটা আগ্রহী হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা এই ভাষ্যের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবে। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, রাহুল গান্ধী কিছু গণমুখী ভাষ্যে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পেরেছিলেন যার সঙ্গে জনগণ একাত্ম হতে পারে যেমনঃ সংবিধান রক্ষা করা, কিংবা হিংসা না বরং ভালোবাসার জন্য রাজনীতি এসবের মাঝেই তরুণ, যুবক, উদারপন্থি, সংখ্যালঘু এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিজেদের খুঁজে পেয়েছে যার প্রভাব পড়েছে নির্বাচনের ফলাফলে।
মোট কথা, বিরোধী দলই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
বিরোধী দলের রাজনৈতিক পদক্ষেপের উপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাফল্য। যেহেতু জনগণই গণতন্ত্রের প্রাণ সুতরাং জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি সরকার ও বিরোধী দল কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না।
লেখক: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি.(অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের গবেষণা সহযোগী