নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
ইন্টারভিউ উইথ ছাগল
শামীমুল হক
৩০ জুন ২০২৪, রবিবার
তবে একটা অনুরোধ করবো, দয়া করে আপনারা একে অপরকে- তুই বেটা একটা ছাগল বলে গাল দেবেন না। এতে আমরা অপমান বোধ করি। আর ছাগল যে কী করতে পারে তার এক ঝলক নমুনা তো এই ঈদে আপনারা দেখলেনই।
আরে বেটা তুই একটা ছাগল! মানুষ আমাদের ছাগল জাতকে নিয়ে প্রায়ই এমন বিরূপ মন্তব্য করে। মানুষ মানুষকে ছাগল বলে গাল দেয়। কিন্তু ছাগল যে মানুষের কতো উপকারে আসে তা কি কেউ একবার চিন্তা করে দেখেছে? সর্বশেষ উপকারের কথা দিয়েই আমার সাক্ষাৎকার শুরু করছি। আপনি জানতে চেয়েছিলেন ছাগল নিয়ে কেন এত হইচই? কেন হবে না বলুন? আমি শুধুমাত্র একটি ছাগলই ছিলাম। কিন্তু আমাকে হেয় করে দেখার মতো কোনো কিছু কি দেখেছেন? বরং আমি ছাগল হয়ে গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছি। আমাকে নিয়ে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কোটি কোটি মানুষ আমাকে দেখেছে টিভি পর্দায়। ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছি আমি। আমি কতো ভাগ্যবান একটু চিন্তা করে দেখেছেন কি? না আপনারা মানুষ জাত। আপনারা কেন এসব চিন্তা করবেন? আপনারা চিন্তা করবেন, অর্থ-কড়ি নিয়ে। আপনারা চিন্তা করবেন সম্পদের পাহাড় গড়া নিয়ে। আপনারা চিন্তা করবেন হাজার বিঘা জমির উপর রিসোর্ট বানানো নিয়ে। আপনারা চিন্তা করবেন সুখ-স্বাছন্দ্য নিয়ে। আপনারা চিন্তা করবেন অন্ধকার জগৎ নিয়ে। আপনারা চিন্তা করবেন ক্লাব, পার্টি নিয়ে। আপনারা চিন্তা করবেন জীবনকে ঢেলে সাজানো নিয়ে। আপনারা চিন্তা করবেন নিজের পথ সুগম করতে অন্যকে কীভাবে বলি দিতে হয়, সেটা নিয়ে। করুন না, করুন। এতে আমার কী আসে যায়! কিন্তু আপনারা যা পারেননি আমি কিন্তু তা করে দেখিয়েছি। আমি সামান্য ছাগল হয়ে দেশের এক রাঘববোয়ালকে সামনে নিয়ে এসেছি। যিনি এনবিআর’র শক্তিশালী এক কর্মকর্তা। আবার বিয়ে করেছেন দুটো। আপনারা জানেন, তার এক পুত্র আমাকে পনেরো লাখ দিয়ে কিনে নিয়েছিল। এরজন্য এক লাখ টাকা বায়না করে গিয়েছিল। কিন্তু এ খবর মিডিয়ায় আসার পর সব গোলমাল হয়ে যায়। এনবিআর’র মতিউর তাকে পুত্র বলে অস্বীকার করে। পুত্রকে অস্বীকার করার মতো ঘটনা আপনাদের মানুষ জাতের মধ্যেই হয়ে থাকে। আমরা ছাগলরা কখনো তা করি না। কারণ আমরা ছাগল, মানুষ নই। আমাদের ঈমান-আকিদা বড়ই শক্ত। বড়ই কঠিন। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন? মতিউরের পুত্রকে অস্বীকার করাটাই কিন্তু তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন বেটা পুত্রকে অস্বীকার করতে গেলি? এমন বোকামি কেউ করে? অস্বীকার করাতেই তো দ্বিতীয় পক্ষের স্বজনরা সরাসরি গণমাধ্যমকে বলেছে ছাগল কেনা সেই ইফাতই মতিউরের ছেলে। বেটা, এরপরই তো সবাই নেমে গেল মতিউরের বিরুদ্ধে। আর যায় কোথায়? একে একে বেরিয়ে এলো মতিউরের অবৈধ সম্পদের হিসাব বিবরণী। বাড়ি, গাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, ব্যাংকে অসংখ্য একাউন্ট।
শুধু তাই নয়, এর আগে মতিউরের বিরুদ্ধে চার চার বার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্বয়ং দুদক কর্মকর্তারা বেকায়দায় পড়েছে। একপর্যায়ে নাজেহাল হয়ে মতিউরকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিতে হয়েছে। এরপরও মতিউর শুধরায়নি। তার অপকর্ম চালিয়ে গেছে। কথায় বলে না- ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। এমনি হয়েছে মতিউরের ক্ষেত্রে। ক্লিন সার্টিফিকেট নিয়ে সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করে তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। কিন্তু এবার আর দুদক নয়, আমি ছাগল তাকে সবার সামনে নিয়ে আসি। আচ্ছা, একটি কথা এখানে না বললেই নয়, আমাকে পনেরো লাখ টাকায় কেন কিনতে হবে? আমি কী পনেরো লাখ টাকায় বিক্রি হওয়ার উপযুক্ত? আমি তো তা মনে করি না। কিন্তু মতিউরের অতি উৎসাহী বেটা মুশফিকুর রহমান ইফাত পনেরো লাখ টাকায় আমাকে কিনে ফেলে। বায়না করে এক লাখ টাকা। আমি নাকি উচ্চবংশীয় ছাগল। তবে উচ্চবংশীয় এই আমি কী না করতে পারি? একবার ভেবে দেখুন। তবে সত্য হলো, আমার দাম পনেরো লাখ চাওয়া হলেও সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ১২ লাখ টাকায় আমাকে কেনা হয়। এজন্য এক লাখ টাকা অগ্রিমও দেয়া হয় । শুধু তাই নয়, বড় কর্মকর্তা মতিউরের সৌখিন ছেলে ইফাত এগারো লাখ টাকায় একটি গরু এবং দুই লাখ টাকার একটি ভুট্টি কেনেন। ভুট্টি চেনেছেন তো আপনারা? তা হলো খর্বাকৃতির গরু। তবে আমাকে কেন্দ্র করে ঈদের আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হন ইফাত। এরপর থেকে তার বিলাসী জীবনযাপনের নানা তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে। আর ঈদের পর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া লুফে নেয় বিষয়টি। সামনে আসে ইফাতের বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের নাম।
শুধু তাই নয়, তার অতীত কীর্তিকলাপও চলে আসে সামনে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, ঈদের আগেই এ নিয়ে হইচই হওয়ায় ইফাত সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন, ছাগল নিয়ে তিনি বিপদে পড়েছেন। তাই এবার গরু-ছাগল কিছুই নেবেন না। তার অগ্রিম দেয়া ১১ লাখ টাকার দাবিও তিনি ছেড়ে দেন। তবে এতক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। দেশব্যাপী প্রশ্ন জাগে একজন সরকারি চাকরিজীবীর কলেজপড়ুয়া ছেলে কীভাবে এত বিলাসী জীবনযাপন করতে পারেন। আর তখনই ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ইফাতের বাবা তাৎক্ষণিকভাবে ছেলের পরিচয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখনই ফেনীর সংসদ সদস্য মিডিয়াকে জানান, এই মতিউরই হলেন ইফাতের বাবা। তবে ইফাতের মা শাম্মী আখতার শিবু মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী। শাম্মীর বাবার বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। শাম্মী ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর আত্মীয়। ইফাতের বাবা মতিউর রহমান এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালেরও প্রেসিডেন্ট। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও শেয়ারবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বড় ব্যবসায়ী তিনি। বিষয়টি তিনি নিজেও অস্বীকার করেননি। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ১৯শে জুন প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে মতিউর রহমান বলেছেন, তিনি বিভিন্ন কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ওই কোম্পানির মালিকদের কাছ থেকে কম দামে কিনে পরে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে অনেক মুনাফা করেছেন। তবে আমি খুশি। সারা দেশে আমি যে এমন একজন ব্যক্তিকে পরিচয় করে দিতে পেরেছি সেজন্য আমার গর্ব হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশবাসী জেনেছেন, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। কী নেই তার? গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, রিসোর্ট, পার্ক, ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা, কানাডায় আলিশান বাড়ি-গাড়ি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে যুগ্ম কমিশনার থাকাকালেই তিনি যেন আলাদিনের চেরাগ পান। যাতে ঘষা দিতেই বেরিয়েছে এত এত সম্পদ। এরই মধ্যে মতিউরের সম্পদের তথ্য জানতে মাঠে নেমেছে দুদক। শুধু কি মতিউর? না আরও আছে। এ ঘটনার পর এনবিআর’র প্রথম সচিব (কর) কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালসহ ১৪ স্বজনের ৮৭টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। ফয়সালসহ ৭ জনের নামে থাকা ১৫টি সঞ্চয়পত্রে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকাও জব্দ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ফয়সালের স্ত্রী আফসানাসহ ৪ জনের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। স্থাবর সম্পদের মধ্যে আফসানা জেসমিনের নামে ১০ কাঠা জমি, ২০০ বর্গমিটারের প্লট, আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে ভাটারা, খিলগাঁও ও রূপগঞ্জে থাকা স্থাবর সম্পদ, আহমেদ আলীর নামে থাকা ফ্ল্যাট ও কার পার্কিংয়ের ৩ হাজার ২২৮ বর্গফুট স্থাবর সম্পদ ও মমতাজ বেগমের নামে থাকা ১০ কাঠা জমি জব্দ করা হয়েছে। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার দুটি সঞ্চয়পত্র, তার স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে চারটি সঞ্চয়পত্রে ৫০ লাখ টাকা, আফতাব আলীর নামে দুটি সঞ্চয়পত্রে ৩০ লাখ টাকা, কাজী খালিদ হাসানের নামে একটি সঞ্চয়পত্রে ৩০ লাখ টাকা, খন্দকার হাফিজুর রহমানের নামে দুটি সঞ্চয়পত্রে ৪০ লাখ টাকা, আহম্মেদ আলীর নামে তিনটি সঞ্চয়পত্রে ৫০ লাখ টাকা ও মাহমুদা হাসানের একটি সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকা রয়েছে। এই প্রথম সচিব শ্বশুরের নামে ৬ কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন রাজধানীর সিদ্বেশ্বরীতে। কথা হলো, ইদানীং এনবিআর, পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা একের পর এক পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছেন। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার কাহিনী শুনে গোটা দেশের মানুষ হতভম্ব, লজ্জিত। কিন্তু যাদের নিয়ে এতকিছু, তাদের শরমের বালাই আছে বলে মনে হয় না। কারণ তারা এখনো নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইছেন। সবই হলো অবাক করা কাণ্ড। দেশবাসী সবই জানেন। কারও কোনো কিছু জানার বাকি নেই। কিন্তু বাংলাদেশে কি শুধুই একজন মতিউর কিংবা ফয়সাল? ছাগলকে কেন এদের খুঁজে বের করে দিতে হবে। এজন্য তো দেশে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের তাহলে কাজটা কী?
যাদের নামে আজ এত আলোচনা তারাই ছোটবেলায় পড়েছেনÑ সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি/ আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে/আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে/...সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি/কিছুতে কাহারে যেন নাহি দেই ফাঁকি। বর্তমান সময়ে কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারও নেই।
ছোটবেলার সেই আদর্শলিপিও এখন আর পড়ানো হয় না বিদ্যালয়ে। কিন্তু যারা ছোটকালে আদর্শলিপি পড়েছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ যদি এমন কাণ্ড-অকাণ্ড ঘটান, তাহলে আদর্শলিপির অবমাননা হয়। আমি ছাগল হয়ে এর চেয়ে বেশি বলা ঠিক হবে না বলেই মনে হলো। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে অনেক কিছুই বলে ফেলেছি। একজন আলোচিত ছাগল হিসেবে সত্যিই আমি গর্বিত। আর এ গর্ব থেকেই এসব আলোচিত লোকদের নিয়ে আজ কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। তবে একটা অনুরোধ করবো, দয়া করে আপনারা একে অপরকে- তুই বেটা একটা ছাগল বলে গাল দেবেন না। এতে আমরা অপমান বোধ করি। আর ছাগল যে কী করতে পারে তার এক ঝলক নমুনা তো এই ঈদে আপনারা দেখলেনই।