নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
প্রশ্নফাঁস এবং অন্যান্য, দেশ যাচ্ছে কোথায়?
মাহবুব নাহিদ
১০ জুলাই ২০২৪, বুধবারআমরা আবার খুব ইস্যুপ্রেমী জাতি। আমরা খুবই ইস্যু নিয়ে মাতামাতি করতে পছন্দ করি। কোনো একটা ইস্যু আসলে ফেসবুক, ইউটিউব কাঁপিয়ে দেই সেই ইস্যু নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ইস্যুটা নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে কিন্তু আদতে এটা নিয়ে মাতামাতি করার মতো তেমন কিছুই না। তবে রহস্যজনকভাবে আমাদের ইস্যু নিয়ে মাতিয়ে দেয়া হয়। শুধু শুধু মাতিয়ে দেয়া হয় না। মাতিয়ে দেয়া হয় বিশেষ কারও বা কোনো মহলের স্বার্থে। কারণ যখন সবাই কোনো ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকে তখন নীরবে নিভৃতে কোনো একটা কাজ সেরে ফেলা যায়।
প্রায় বছর দশেক আগের কথা, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস নিয়ে তোলপাড় রাজধানী ঢাকা। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হওয়ার পরে সবাই মনে করলো এটাই বোধহয় দেশের সবচেয়ে বড় ফাঁস হওয়ার ঘটনা! যেখানে ডাক্তার বানানো হবে, মানুষের জীবন বাঁচাতে নিয়োজিত থাকবে যারা, তারা কিনা ভর্তি হবে অবৈধ পন্থায়। এই কথা শুনলেও তো কেমন লাগে। কিন্তু কেমন তেমন লাগার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ফাঁস তো অনেক পরের কথা, হয় আরও অনেক কিছুই।
এই দেশে চলে ইস্যুর খেলা, কোন ইস্যুর পরে কোন ইস্যু আসবে তা কেউ জানে না। এক আলাদীনের চেরাগ হয়তো পেছনে বসে বসে একটার পর একটা ইস্যু পাঠাতে থাকে। যারা লেখালেখি করে, কন্টেন্ট বানায়, আলোচনা করে- তাদের হয়ে গেছে বিপদ, কোনটা রেখে কোনটা নিয়ে করবে- ঠিক থাকে না। একটার পর একটা ইস্যু এসে আমাদের একদম টালমাটাল করে দেয়। এই যে, প্রশ্নফাঁস এলো, এর আগে কিন্তু বেশ কিছু টপিক ছিল আমাদের হাতে। প্রথমত বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ খেলে দেশে ফিরে এসেছে। তাদের খেলার যা অবস্থা ছিল তাতে দেশের মানুষের মন-মর্জি খুব একটা ভালো থাকার কথা ছিল না। তার উপর কোরবানির সময় সাদিক অ্যাগ্রোর এক ছাগল নাড়িয়ে দিলো পুরো দেশকে। ছাগল ছাগলের জায়গায় থেকে গেলেও সে শেষ করে দিলো তার মাতা-পিতা, পুত্র-সন্তান, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে। এর মধ্যেই আবার শুরু হয়ে গেল সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আন্দোলন। এই পেনশন স্কিমের আন্দোলন নিয়ে এমনিতেই শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বসে আছে। শিক্ষকরা একা বন্ধ করলে কেমন দেখায়! এজন্য সামনে চলে আসলো ছাত্ররাও। ছাত্ররা অবশ্য সামনে আসতো না, তাদের আসার কোনো কারণ ছিল না। পরিস্থিতি তাদের সামনে আসতে বাধ্য করেছে। একদা বাদ হয়ে যাওয়া কোটা আবার ফিরে এসেছে। এবার অবশ্য ফিরে এসেছে হাইকোর্টের রায়ে। কোটা নিয়ে আবারো আন্দোলন চলমান। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে আন্দোলন। এই আন্দোলনকে অনেকেই রাস্তার জ্যাম বলেই দাবি করছেন। ঘটনা তো অনেকটা তেমনই। যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন বিপদ হলে তাদের হোক। সাধারণ মানুষের এখন হিসাব করে বের হতে হচ্ছে কোথায় গেলে কোথায় জ্যামে পড়বে। রাস্তাঘাট আটকা থাকছে বলে মানুষ সব হামলে পড়ছে বেচারা মেট্রোরেলের ওপর। যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তারা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করে।
ইস্যু এখানেই শেষ নয়, ইস্যুর শেষ থেকেই তো অন্য ইস্যুর শুরু হয়। বরিশালে একটা প্রবাদ আছে, ‘হপায় রোজার হিশ, এক আছে সাড়ে নয় আরও আছে বিশ।’ ইস্যু তো একটার পর একটা খোলস খুলে বের হবেই। কোটা নিয়ে যারা আন্দোলন করছেন তারা হয়তো একটা হৃদস্পন্দনে একদম থ’ হয়ে যাবেন, তাদের কাছে মনে হবে এই পৃথিবীতে কেউ নেই, কিছু নেই, চারপাশ ধু-ধু বালুচর, মনে হবে যেন সৌদি আরবের মরুভূমির বালির মধ্যে সাঁতার কাটছেন তারা।
যেই চাকরির পরীক্ষা নিয়ে তাদের এত যুদ্ধ সেই চাকরির পরীক্ষার সর্ষের মধ্যে ভূত যে আছে তা তো আগে থেকে সবাই জানেনই। কিন্তু সবার মনের গহীন কোণে একটা নাম ছিল, যেই প্রতিষ্ঠানের উপর একটা ভরসা সবার ছিল। বিশেষ করে পিএসসি নামক ঐ প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা হোক কিংবা বিসিএস নামটার উপর হোক, ভরসা তো একটা ছিলই। কিন্তু সকলের আশার আলোয় এমন ঘন কালো অন্ধকার নেমে আসবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি! পিএসসি’র বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে-এমন খবর প্রচার করেছে চ্যানেল২৪। মানুষ যেন নিজের চোখকে, কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আসলেই কি সম্ভব? আসলেই সম্ভব, এই দেশে সকল কিছুই সম্ভব। দেশের দুর্নীতি দমনের এবং রোধের দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের বড় বড় দায়িত্বের লোকদের দুর্নীতির তালিকা দেখলেই তো বোঝা যায়, এদেশে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়া রয়েছে। এখানে আর অসম্ভব বলে কিছুই নেই।
একটু ফিরে যাই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায়। একজনকে খুঁজে পেলাম সে নাকি পরীক্ষায় একশ’র মধ্যে ৯৮ পেয়েছে। সে লুকিয়ে থাকতে চায় না, সে নাকি বুক ফুলিয়ে বলতে চায় সে সত্যিই পরীক্ষা দিয়ে এই নম্বর পেয়েছে, সে প্রশ্নফাঁসের কিছুই জানে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে তাকে দেখলেই তো চোর চোর লাগে।
এই যে, পিএসসি’র প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সামনে এলো, এদের কি আসলেই শাস্তি হবে? নাকি এরাও টাকার গরমে বেঁচে যাবে? আর যারা প্রশ্ন কিনে সুযোগ পেয়েছে তারা তো থেকে গেলই। কারণ ওই মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নফাঁস হয়েছিল সেইবারের কেউ তো আর বাতিল হয়নি। অনেকেই বলেছেন যে, মনে থাকবে কোন বছর ভর্তি হয়েছে!
দুইটা বিষয় বর্তমান সময়ে খুব বেশিই দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসা আর এক ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় অন্য কিছু ঘটে যাওয়া।
প্রথমেই আসি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়া নিয়ে। দেখা গেল একটা বাড়িতে একটা খুন হয়েছে। এবার সেই বাড়িতে পুলিশ আসবে, তদন্ত হবে। এরপর দেখা যাবে সেই বাড়ির অনুমোদনই ছিল না। সেই বাড়ির পানি গ্যাস বিদ্যুতের লাইন অবৈধ! ওই বাড়ির মালিক আয়কর দেন না, ওই বাড়িতে মদের বার আছে, ওই বাড়িতে টর্চার সেল আছে। খুব ভালো একটা তদন্ত হয়েছে মানলাম। কিন্তু এই যে, বিষয়গুলো আগে থেকে ওখানে ছিল তা তো জানার বা খোঁজার দায়িত্বে কেউ নিয়োজিত ছিল, তারা আগে কী করেছে? তারা কেন এগুলো আগে খুঁজে বের করতে পারলেন না? একটা ঘটনা ঘটার পরে কেন এই জিনিস বের হয়!
এরপর দেখা যায়, কোনো একটা অপরাধ সংঘটিত হয়। অপরাধীর দিকে সব নজর না দিয়ে ভিকটিমের দিকে নজর ঘোরানো হয়! ভিকটিমকে নিয়ে বেশি মাতামাতি করা হয়। মূলত যারা অপরাধী থাকে, তারা হয় অনেক ক্ষমতাধর, তাদের থেকে ফোকাস ঘোরানোর জন্য ভিকটিমকে নিয়ে মাতামাতি করা হয়! এবং পরিশেষে অনেক ক্ষেত্রেই ভিকটিমকেই দোষী বানানো হয়!
আমরা আবার খুব ইস্যুপ্রেমী জাতি। আমরা খুবই ইস্যু নিয়ে মাতামাতি করতে পছন্দ করি। কোনো একটা ইস্যু আসলে ফেসবুক, ইউটিউব কাঁপিয়ে দেই সেই ইস্যু নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ইস্যুটা নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে কিন্তু আদতে এটা নিয়ে মাতামাতি করার মতো তেমন কিছুই না। তবে রহস্যজনকভাবে আমাদের ইস্যু নিয়ে মাতিয়ে দেয়া হয়। শুধু শুধু মাতিয়ে দেয়া হয় না। মাতিয়ে দেয়া হয় বিশেষ কারও বা কোনো মহলের স্বার্থে। কারণ যখন সবাই কোনো ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকে তখন নীরবে নিভৃতে কোনো একটা কাজ সেরে ফেলা যায়।
প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত সবাইকে ছাপিয়ে একটা মানুষকে নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, তিনি হচ্ছেন আবেদ আলী! এই ব্যক্তি ঘৃণিত কাজ করেছেন, এর দায় তার একান্ত নিজের। এর জন্য তার বেশভুষা, দাড়ি- টুপিকে দায় দেয়ার কোনো কারণ নাই। তিনি নিজেকে প্রচারের জন্য ভিন্নভাবে সেজেছেন, এটা তার মুখোশ।