নির্বাচিত কলাম
অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে অন্ধকারে আমরা, সংবাদপত্রের সামনে চ্যালেঞ্জ
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২২ জুলাই ২০২৪, সোমবারভয়ে বুক কাঁপে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসেও এ কোন বাংলাদেশ দেখছি আমরা। শুধু বিভেদ। বিশ্ব যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যাত্রা কোন পথে! যেকোনো সমস্যার সৃষ্টি হলেই আমরা তার ত্বরিত সমাধান খুঁজি না। কেউ উপযুক্ত পরামর্শ দিলেও তা গায়ে মাখি না। মনে করি, ওই পরামর্শ গ্রহণ করলে আমি ছোট হয়ে যাবো। উল্টো আমি যা মনে করি, শত চেষ্টা করে হলেও তার ওপর অবিচল থাকার চেষ্টা করি। চেষ্টা করি মানে- সর্বশক্তি দিয়ে তা বাস্তবায়ন করি। এর ফলে বিভেদ বাড়ছেই। বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গেছে, যেখান থেকে মুক্তির পথ দেখা যাচ্ছে না। বরং সেই বিভেদ আরও বাড়ছে। বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের যখন এগিয়ে যাওয়ার কথা, তখন এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করায় ব্যস্ত আমরা। চারদিক থেকে যে খবর আসছে, তাতে কোনো আনন্দ নেই। স্বস্তি নেই। অন্তত আমি নিজের ভেতর স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছি না। গ্রাম থেকে মায়ের ফোন- বাবা, সাবধানে থাকিস। মাকে সান্ত্বনা দিই। তিনি কখনো বোঝেন। কখনো বোঝেন না। মায়ের মন বোঝার কথা না। তিনি অস্থির থাকেন। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে এ খবর আরও বহুগুণ বৃদ্ধি হয়ে জল্পনা ছড়াচ্ছে। বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকম জল্পনা। ইন্টারনেটে গুজব ছড়ালে তাকে প্রতিরোধ করার জন্য সরকারের হাতে হাতিয়ার আছে। সাইবার সিকিউরিটি সহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ আছে। কিন্তু বাতাসে যে খবর ছড়ায় তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কারও নেই।
বাতাসের গুজব কোনো বন্দুকের নল মানে না। ফলে পেশাগত কারণে এখান থেকে ওখান থেকে ফোন। কি উত্তর দেবো জানি না। বিদেশি মিডিয়াগুলোতে নানা রকম খবর। শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের এ পরিণতি নিয়ে অনেক ‘ক্রিটিক’ বা সমালোচনামূলক খবর প্রচার হচ্ছে। কি খবর প্রকাশ করছে তারা, ইন্টারনেট না থাকার কারণে জানা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু কি লিখা হচ্ছে বিদেশে তা বুঝতে বাকি থাকে না, যখন বাংলাদেশ এ ইস্যুতে নিজেই বিবৃতি দিয়ে বলে- ‘এই ইস্যু (কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চলমান সংকট) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।...যাচাই করা হয়নি এমন তথ্যের ভিত্তিতে কিছু বিদেশি মিডিয়ায় যেসব খবর প্রকাশ করা হয়েছে তার নিন্দা জানাই আমরা। তাদেরকে যাচাই না করে বিকৃত যেকোনো তথ্য প্রকাশ করা থেকে সর্বোচ্চ বিচক্ষণতা প্রদর্শনের আহ্বান জানাই। আমরা আশা করি, পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আমাদের বিদেশি বন্ধুরা ও অংশীদাররা প্রশংসা করবেন এবং সংশ্লিষ্ট যেকোনো তথ্য বা ফ্যাক্টের বিষয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’
এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, বিদেশি মিডিয়া যদি ভুল, বস্তুনিষ্ঠ বা ভুয়া খবর প্রকাশ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ পাঠানোর নিয়ম আছে। এর বাইরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান আছে। কারণ, তারা যদি আমার দেশ নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট প্রকাশ করে, তা সরকারের জন্য এবং এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমার জন্যও অপমানের। আমাদেরকে নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট প্রকাশ করলে তাদের বিরুদ্ধে সরকার মামলা করতে পারে। কিন্তু যখন এই লেখা লিখছি তখন পর্যন্ত সরকার ওইসব মিডিয়ার কাছে প্রতিবাদ পাঠিয়েছে কিনা বা তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা- তা নিশ্চিত নই। যদি এমন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে তাহলে সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কারণ, এর সঙ্গে নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার মান-সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু কোন মিডিয়া কি ভুয়া খবর বা তথ্য যাচাই না করে খবর প্রকাশ করেছে, তা সরকার পরিষ্কার করেনি। যদি ইন্টারনেট সচল থাকতো, তাহলে নাগরিক হিসেবে আমরাও ওই তথ্যের সত্যতা বা যথার্থতা যাচাই করতে না পারলেও অন্তত অনুধাবন করতে পারতাম। কিন্তু তা তো করা হচ্ছে না! আমার দেশকে নিয়ে কোন দেশ, কোন দেশের মিডিয়া ভুয়া তথ্যের ওপর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা জানিয়ে দিলে তাদেরকে আমরা শনাক্ত করতে পারতাম। তারা কারা, কি উদ্দেশ্যে সেই ভুয়া বা ভুল রিপোর্ট প্রকাশ করেছে- তার কিছুটা জাতি জানতে পারতো।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তস্নাত এই বাংলাকে নিয়ে এমন ভুল তথ্যসমৃদ্ধ রিপোর্টের নিন্দা জানাই। সরকারের পক্ষ থেকে যতক্ষণ ওইসব মিডিয়ার খবর আমাদেরকে জানতে দেয়া হচ্ছে না, ততক্ষণ সাংবাদিক হিসেবে স্বস্তি মিলছে না। এর আগেও আমরা দেখেছি লন্ডনের বিখ্যাত ইকোনমিস্ট পত্রিকায় বাংলাদেশ নিয়ে খবর প্রকাশের কারণে সরকার তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। যদি ভুল করে না থাকি তাহলে তাদের বিরুদ্ধে খুব সম্ভবত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছিল সরকার। এর আগে বাংলাদেশ নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, আল জাজিরা, লন্ডনের বিখ্যাত গার্ডিয়ান, বিবিসি সহ বিশ্বের নামকরা সব গণমাধ্যম ও অনলাইন নিউজ আউটলেটগুলো। সে সময় ইন্টারনেটের অবাধ সুযোগ ছিল। প্রতিটি রিপোর্টকে নাগরিক হিসেবে আমরা যাচাই করে দেখার সুযোগ পেয়েছি। নিজেরা বুঝতে পেরেছি, তারা ভুল তথ্য দিচ্ছে নাকি সঠিক তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু এখন পুরো জাতি তথ্যের দিক থেকে অন্ধকারে। কোথায় কি হচ্ছে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এখন ওইসব মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে কি লিখছে, বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কি খবর দিচ্ছে- তা রয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। কারণ, ইন্টারনেট নেই। ইন্টারনেট সেবাদানকারী সার্ভার পুড়ে গেছে বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বলা হয়, শিগগিরই ইন্টারনেট চালু করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু কতো দিনে সেই শিগগির আসবে তা আল্লাহ মালুম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ডাটা বন্ধ কেন? তাদেরও কি সার্ভার পুড়ে গেছে? কই কোনো সংবাদ মাধ্যমে তো এমন কোনো বক্তব্য আসেনি। কোনো ইন্টারনেট সেবাদানকারী মোবাইল ফোন অপারেটররা তো পরিষ্কার করেননি কেন তাদের ডাটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মোদ্দাকথা, এসব পর্যালোচনা শেষে মনে হচ্ছে এটা ইচ্ছাকৃত প্রমাদ। পুরো জাতিকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে, যেন তারা কোনো তথ্য জানতে না পারেন। কিন্তু কেন, অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে একটি পুরো জাতি এভাবে তথ্যের অন্ধকারে ডুবে থাকবে। ইন্টারনেট ডাটা সেন্টারে হামলার নিন্দা জানাই। নিন্দা জানাই যেকোনো সহিংস হামলার। যেকোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই। কিন্তু তাই বলে কোনো মহলকে শায়েস্তা করতে গিয়ে পুরো দেশকে এভাবে তথ্যের অন্ধকারে রাখার অর্থ কি? একবিংশ শতাব্দীতে এসে রীতিনীতি পাল্টে গেছে।
মানুষের সবকিছু ইন্টারনেটকেন্দ্রিক, অনলাইনভিত্তিক। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার ফলে শুধু যে তথ্যের সংকটে ভুগছে জাতি, এমন নয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, লেনদেন, ব্যবসা সবকিছুই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে বলতে এসব যে বন্ধ হয়ে গেছে এমনটা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। শুধু পিছিয়ে পড়া নয়, তাদের বিরাট লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। এখনো ব্যবসায়ী সম্প্রদায় অবশ্য তা নিয়ে বড় করে মুখ খোলেননি। যদি তারা রাস্তায় নেমে পড়েন- তখন কী জবাব হবে! তাতে কি পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে না? এই একবিংশ শতাব্দীতে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের প্রায় সব সংবাদ মাধ্যম প্রায় পুরোদমে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর সামনে কঠিন এক সমস্যা দেখা দিয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার খবর পর্যন্ত যথাযথভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশে সম্পাদক পরিষদ থেকে সরকারের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে। দ্রুত ইন্টারনেট চালু করার দাবি তুলেছেন এই পরিষদ। কতোটা ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন তারা তা তাদের বিবৃতিই বলে দেয়।