ঢাকা, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, রবিবার, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

যুদ্ধ দিনের কথা

ফারজানা হক
২২ জুলাই ২০২৪, সোমবারmzamin

ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন ছিল শিক্ষানুরাগী আবু তালেবের। দারিদ্র্যের কষাঘাতে তার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত হয়েছিলেন ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলের কর্মকর্তা। আর সেখানে কর্মরত অবস্থাতেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একদিন সেখানেও হানা দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরিচিত সেনা কর্মকর্তা তাকে ছেড়ে দিতে চাইলেও তিনি সহকর্মীদের বিপদের মধ্যে রেখে চলে যেতে রাজি হননি। শেষে ঘাতকের নির্মম বুলেট তাকে ঝাঁঝরা করে দেয়। 
১৯৭১ সালের পহেলা ডিসেম্বর ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলস ঘেরাও করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। প্রায় ১০০ জন লোককে কোয়ার্টারের সামনের মাঠে দাঁড় করানো হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর  মেজর আরিফ আবু তালেবকে চিনতেন- বলেছিলেন, ‘বাঁচার ইচ্ছা থাকলে এখনই এই এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু সাবধান মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে মারা পড়বেন।’ শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘বাঁচতে হলে, এলাকার সবাইকে নিয়েই বাঁচবো। আমার একটা কর্মচারীকে মারার আগে প্রথমে আমাকে মারতে হবে।’ 

এসময় ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে আবু তালেবের বাম হাতটি উড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই প্রায় আরও একশ’ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে মেরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পরে মাটিতে পড়ে থাকা আবু তালেবের রক্তাক্ত দেহ তার  কোয়ার্টারে আনা হয়। রক্ত বন্ধ করার জন্য মিলের ডাক্তার তাকে ইনজেকশনও দিয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ওইদিন রাতে মারা যান আবু তালেব। তার অধীনস্থ কর্মচারীরা সেদিন রাতেই  ঘোড়াশাল থেকে এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে একটি ক্ষেতের মধ্যে তার লাশ দাফন করে। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় আবু তালেবের নাম প্রকাশ হয়। কিন্তু আজও পর্যন্ত আবু তালেবকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। তাই প্রসঙ্গত কারণেই তাকে নিয়ে এই লেখা।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর দেশের সংকটজনক পরিস্থিতিতে নিজ প্রাণ রক্ষার্থে অনেকেই কোয়ার্টার ছেড়ে পালিয়ে গেলেও আবু তালেব নিজ  কোয়ার্টার ছেড়ে পালাননি। তিনি  যোগদানের পরে সেখানকার অফিসার্স  কোয়ার্টারেই থাকতেন এবং কয়েকজন অফিসার মিলে জুট মিল চালিয়ে  রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি  গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ, গরম কাপড় দিয়ে সাহায্য করতেন।  ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলসের ম্যানেজার ছিল বিহারী। সে পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে আবু তালেবের কথা জানিয়ে দিলে পহেলা ডিসেম্বর ঘেরাও করে ঘোড়াশাল জুট মিল। 
১৯৬৫ সালে আবু তালেব শিক্ষকতার  পেশা ছেড়ে ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলে অ্যাডমিনিস্টেটিভ অফিসার পদে  যোগ দেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আবু তালেব নিজ কর্মদক্ষতার কারণে প্রশাসনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে উন্নীত হন। তিনি গ্রামের অভাবী  লোকদের চাকরি দেয়ার চেষ্টা করতেন। রাজেন্দ্র নামের এক বড় ডাকাতকে তিনি মিলের দারোয়ান পদে নিযুক্ত করেছিলেন। এই দারোয়ান আবু তালেবের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার সঙ্গে ছিল।
শহীদ আবু তালেবকে শিক্ষানুরাগী হিসেবে এজন্যই আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি যখন নীলফামারীর  সৈয়দপুর কলেজে অধ্যাপনা করেছেন তখন তার নিজ গ্রাম ঠাকুরগাঁওয়ের মাদারগঞ্জে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিক্ষার আলো গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে অর্থ সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই পাঠাগারটি। কিন্তু এই পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তার নামটিও আজ মুছে গেছে। 
শহীদ আবু তালেব ১৯৩৯ সালে তৎকালীন দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ফকদনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আহম্মদ উদ্দীন আহম্মদ পেশায় ছিলেন একজন দারোগা। মা রহিমা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী। আবু তালেব ঠাকুরগাঁওয়ের মাদারগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এন্ট্রাস পাস করেন ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এবং বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন।
তার স্বপ্ন ছিল ব্যারিস্টার হওয়ার। ১৯৬০ সালে যখন আবু তালেব বগুড়ায় বি.এ. পড়তেন, তখন তিনি প্রায়ই  রেডিওতে বিবিসি’র খবর শুনতেন। তিনি বিবিসি’র খবর শোনার সুবাদে ইংরেজি উচ্চারণের চেষ্টা করতেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্সে এমএ প্রথম পর্বে ভর্তি হন। পাশাপাশি তিনি ল’ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। এসএম হলের ১৪৪ নম্বর রুমে থাকতেন। 
পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে পড়ালেখার খরচ জোগানো সম্ভব ছিল না তার। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য কম বয়সেই বিয়ে করতে বাধ্য হন। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ থেকে ২৫শে  সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নাটকে অংশগ্রহণ করেন। আবু তালেব এমএতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে আবু তালেব সৈয়দপুর কলেজের পলিটিক্যাল সায়েন্সের  লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সফরের জন্য একটা টিম পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আবু তালেব সেই সফরের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু যথাসময়ে টাকার ব্যবস্থা না করতে পারায় আবু তালেব  সেই সফরে যেতে পারেননি। পয়সার অভাবে বাস্তবায়িত হয়নি আবু তালেবের ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন। তার এই আত্মোৎস্বর্গ যেন মুছে না যায় ইতিহাসের পাতা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের পাতায় উঠে আসুক শিক্ষানুরাগী আবু তালেবের নাম। জাতি এবং নতুন প্রজন্ম তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করুক- এমন প্রত্যাশা করি।

লেখক: শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
[email protected]

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status