ঢাকা, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, রবিবার, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

ইন্টারনেট বন্ধের সুফল ও কুফল

শামীমুল হক
২৩ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবারmzamin

এনালগ যুগ শেষ হয়েছে নব্বইয়ের শেষদিকে। এরপর মানুষ দিনে দিনে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। এখন আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক সিস্টেম যোগ হয়েছে। দেশে স্যাটেলাইট যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে মিডিয়া জগতে ডিজিটাল সিস্টেম আলোড়ন তুলেছে। একেবারে বদলে গেছে কাজের ধরন। এনালগ যুগে রাত তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত কাজ শেষে সাংবাদিকরা বাড়ি ফিরতেন। ভোরে পত্রিকা ছাপা হতো। এরপর এ পত্রিকা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেতো। কোনো কোনো জেলায় আজকের পত্রিকা পাঠকরা হাতে পেতেন পরদিন কিংবা তারও পরদিন। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা রিপোর্ট কাগজে লিখে ডাকযোগে পাঠাতেন নিজ নিজ অফিসে। সেই রিপোর্ট ছাপা হতো সপ্তাহ দশদিন পর। আবার ডেইলি রিপোর্ট অফিসে দিতে গিয়েও গলদঘর্ম হতে হতো সাংবাদিকদের। অনেক থানা কিংবা উপজেলা শহরে ফ্যাক্স মেশিন ছিল না। তাদের দৌড়াতে হতো জেলা শহরে। সেখানে গিয়েও পড়তে হতো বিড়ম্বনায়। একটি মাত্র ফ্যাক্স মেশিন। সাংবাদিকদের লাইন। ফ্যাক্সে রিপোর্ট পাঠাতে গিয়ে দেখা গেল অর্ধেক রিপোর্ট যাওয়ার পর কাগজ ছিঁড়ে গেছে। আবার চেষ্টা করার পালা। লাইন পেতে গিয়েও হতে হতো নাস্তানাবুদ। আর যদি মাঝখানে অন্য কোনো পত্রিকার সাংবাদিক ঢুকে পড়ে তাহলে অপেক্ষার পালা। অনেক কষ্টে ফ্যাক্সে রিপোর্ট পাঠানোর পর এখন জানার পালা ঠিকভাবে তা পেয়েছে কিনা? জেলা শহরের এনালগ টিঅ্যান্ডটি অফিসের দ্বারস্থ হতে হতো সাংবাদিকদের। এবার শুরু নিজ নিজ অফিসের ল্যান্ড ফোনের লাইন পাবার লড়াই। কখনো অল্প সময়ে আবার কখনো দীর্ঘ সময়ে লাইন পাওয়া গেলেও দু’পাশে থাকা দু’জনের কথা বুঝাটাও ছিল আরেক মহা-ঝামেলার। একপাশ থেকে একটা শব্দ বললে অন্যপাশের জন বুঝে নিতেন অন্য শব্দ। এমনও ঘটনা ঘটেছে এমন শব্দ ছাপা হয়েছে যা সম্পূর্ণ উল্টো। এভাবে লড়াই করে রিপোর্ট পাঠানো হতো। পত্রিকা অফিসগুলো তখনো লেটার প্রেসে ছাপা হতো। অর্থাৎ রিপোর্ট সাজানো হতো লাইন ধরে ধরে অক্ষর বসিয়ে। নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে পত্রিকায় সংযোজন হয় কম্পিউটার। আস্তে আস্তে লেটার প্রেস জায়গা করে নেয় ইতিহাসে। প্রেসে আসে আধুনিকতা। একসঙ্গে গোটা একটি পত্রিকা বেরিয়ে আসে প্রেস থেকে। তখন মনে হতো এ এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। এই আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিপ্লব ঘটায় দৈনিক মানবজমিন। রাত তিনটার বদলে পত্রিকা প্রেসে পাঠানো হয় রাত ৮টায়। সে সময় দৈনিক মানবজমিন রাতের মধ্যে দেশের সকল জেলা-উপজেলায় পৌঁছে যেতো। পাঠকের কি যে আনন্দ। আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে আনে সকল পত্রিকা। কথা হলো-গত ক’বছর ধরে দেশে যখন ইন্টারনেট যুক্ত হয় তখন ঘটে আরেক বিপ্লব। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এক মুহূর্তে মেইলে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেন। এরপর মোবাইল ফোনে সংশ্লিষ্ট ডেস্কে জানিয়ে দেন রিপোর্ট পাঠানোর কথা। ঢাকায় কর্মরত হেড অফিসের সাংবাদিকদেরও আর কাগজ কলমে লিখতে হয় না। সবার সামনে কম্পিউটার। সারাদিন নিজের বিটে খোঁজখবর নিয়ে বিকালে অফিসে এসে কম্পিউটারের কী বোর্ডে আঙ্গুল চালাতে থাকে। মুহূর্তে তৈরি হয়ে যায় রিপোর্ট। কিছুদিনের মধ্যেই ডিজিটালে যুক্ত হয় ইন্টারনেট। মোবাইল ফোনগুলো বিক্রি শুরু করে ডাটা। আর ডিশ ব্যবসায়ীরা যুক্ত করেন ওয়াইফাই। মাসিক বিলের মাধ্যমে ঘরে ঘরে সংযোগ দেয়া শুরু হয়। এরই মধ্যে ফেসবুক জায়গা করে নেয় মানুষের হৃদয়ে। দিনে দিনে ফেসবুকের গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে থাকে। মানুষ ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা বলা শুরু করে। সঙ্গে যুক্ত হয় ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ নানা অ্যাপ। কথা শুরু হয় এসব অ্যাপে। চলে দীর্ঘ সময় কথা। এসব আসার আগে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো রাতের জন্য আলাদা প্যাকেজ ছাড়ে। রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত এ প্যাকেজের মূল খরিদ্দার ছিলেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। তারা এ প্যাকেজের আওতায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন। সেটি এখন হারিয়ে গেছে ইমো আর হোয়াটসঅ্যাপের কাছে। শুধু কথা নয়, এসব অ্যাপে ছবি, ভিডিও এবং চ্যাট করা যায়। ফলে এসব অ্যাপের জনপ্রিয়তা দ্রুত তুঙ্গে উঠে। আর পত্রিকাগুলো এসব অ্যাপের সর্বোচ্চ ব্যবহার শুরু করে। ইন্টারনেটের সুবিধা শুধু পত্রিকা নয়, বড় বড় করপোরেট হাউজ থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যবসায়ীরাও লুফে নেয়। প্রবাসীরাও এর সুবিধা নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে আন-লিমিটেড কথা বলতে পারেন। দেশের ব্যবসায়ী যারা ভিন দেশের সঙ্গে ব্যবসা করছেন তারা একে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ গোটা বিশ্বটাকেই হাতের মুঠোয় এনে দেয় ডিজিটাল ব্যবস্থার এসব অ্যাপ। ডিজিটাল সিস্টেমের এত সুফলের পরও রয়েছে অনেক কুফলও। এই ইন্টারনেট বিশ্বব্যাপী নিয়ে এসেছে অনলাইন জুয়া। যে জুয়ায় লাখ লাখ তরুণ হচ্ছে নিঃস্ব। বিশেষ করে ফেসবুকে গুজবের নহর বয়ে যায় অনেক সময়। কিন্তু এটাও ঠিক ফেসবুকে গুজব ছড়ালেও মুহূর্তেই তা খোলাসা হয়ে যায়। কারণ মানুষ আজকাল আর সেই বোকা নেই। তারা ফেসবুকের কারও লেখার উপর ভরসা না করে নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে সঠিকটা জানতে পারে। ফলে গুজবকারী ব্যর্থ হয়ে যায় খুব সহজেই। বরং নেট বন্ধ থাকলে মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়ায়। আতঙ্ক ছড়ায়। গুজবের ডালপালার বিস্তার ঘটে। কারণ নেট বন্ধ থাকায় গুজব যে শুধুমাত্র গুজব তা কেউ খণ্ডনও করতে পারে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। অনেক সময় দেখা যায় গুজবের উপর বিশ্বাস করে অনেক অঘটনও ঘটে যেতে পারে। ইতিমধ্যে এমন অনেক অঘটনের কথা সবারই জানা। নেট বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। যা পূরণ করা আর সম্ভব নয়। 
গত ১৬ই জুলাই থেকে নেট  স্লো হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার রাত থেকে নেট একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। আর শুক্রবার রাত থেকে দেশে শুরু হয় কারফিউ। কোটা সংস্কার দাবিতে দেশ জুড়ে শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি, আর সারা দেশে কারফিউ জারি থাকার মধ্যে নেট পুরোপুরি বন্ধ থাকায় মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ কার্যত বিচ্ছিন্ন। এতে ইন্টারনেটভিত্তিক লেনদেনে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। রেমিট্যান্স আসার পথও বন্ধ হয়ে পড়ে। আমদানি পণ্যও ছাড় করা যাচ্ছে না। অচল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের কাস্টমস শুল্কায়ন কার্যক্রম। অন্যদিকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে ই-কমার্স খাত। বিক্ষোভের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া দ্রুতগতির ফোরজি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ইন্টারনেটভিত্তিক মোবাইল আর্থিক সেবাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর। আমদানি-রপ্তানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ই-মেইলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে ই-মেইলে প্রয়োজনীয় নথিপত্রও পাঠাতে হয়। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ব্যাংক ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বিদেশি ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জগুলোর মাধ্যমে প্রবাসীরা বৈধ পথে দেশের ব্যাংকগুলোয় রেমিট্যান্স পাঠান। আন্তর্জাতিক লেনদেন সিস্টেম সুইফটের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের বার্তা বিটিআরসি গেটওয়ে হয়ে দেশে আসে। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে সেসব বার্তা নিশ্চিত করা হলে তবেই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্সের অর্থ জমা হয়। কিন্তু ইন্টারনেট না থাকায় রেমিট্যান্স আসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সমুদ্রকেন্দ্রিক আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশ সম্পন্ন হয়। কিন্তু ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। খবর বেরিয়েছে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় বৃহস্পতিবার থেকে সার্ভার কাজ করছে না। ফলে বন্দর ও কাস্টমসে আমদানি ও রপ্তানি সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। এ ছাড়া ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলোর ডিজিটাল সেবার অনলাইন লেনদেন বন্ধ রয়েছে। এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারছে না গ্রাহকরা। মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, মোবাইলে ইন্টারনেট না থাকায় লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। বিপাকে পড়েছেন মোবাইলে আর্থিক সেবাপ্রদানকারী এজেন্টরা। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় তারা ই-মানি সুবিধা নিতে পারছেন না। ফলে অনেক এজেন্ট ক্যাশ ইন সেবা দিতে পারছেন না। নেট সমস্যাটা শুরু হয় ১৭ই জুলাই থেকে। তখন নেট চলছিল একেবারে  স্লো। কিন্তু পরদিন ১৮ই জুলাই রাত থেকে ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর দিন শুক্রবার ১৯শে জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ কার্যকর করা হয়। যা এখনো চলছে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধের সুফল আর কুফল নিয়ে ভাবলে কোন্‌টা যে এগিয়ে যাবে তা পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন।

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status