ঢাকা, ৭ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

জীবন সংগ্রামের মানে জানে মানিব্যাগ

পিয়াস সরকার
২১ জুলাই ২০২৪, রবিবার

 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষে ঢাকায় চাকরি করছেন গোলাম রাসেল। তিনি বলেন, ভার্সিটি শেষ করে এখন একটা চাকরি করছি। এ দিয়ে আমি নিজেই চলতে পারি না। বাবা-মায়ের কাছে টাকা পাঠাবো কীভাবে? বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে চাপ আছে বরাবরই। এখন আমি চলতে পারি না- বিয়ে করবো এটা ভাবতেও পারি না। ধীরে ধীরে হতাশায় পড়ে যাই। আর মানিব্যাগের দিকে তাকালেই নিজেকে অসহায় লাগে।

মানিব্যাগ। জীবনের এক ছায়াসঙ্গী। তবে কখনো এ মানিব্যাগ জীবনকে ভাবিয়ে তুলে। কখনো কখনো অতল গহ্বরে ফেলে দেয়। আবার এ ম্যানিব্যাগই কখনো জীবনকে করে তুলে রঙিন। সত্যিই মানিব্যাগ এক ক্যারিশমেটিক চরিত্র। এ চরিত্রই প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে লেপ্টে আছে। এর জন্যই মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা খুঁজে ফেরে ভবিষ্যৎ। মানিব্যাগে টাকা থাকলে দিন চলে একরকম। আর যদি তা শূন্য হয় তাহলে জীবন হয় মলিন। সত্যিই বলতে কি প্রতিটি মানুষের জীবনই বন্দী মানিব্যাগে। 
গত বছর ডিসেম্বরে রংপুর থেকে ঢাকায় আসছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আদিত্য আরাফাত। প্যান্টের সামনের বাম পকেটে ছিল ব্যাগটি। কিন্তু সিরাজগঞ্জে যাত্রা বিরতি শেষে বাসে উঠে দেন ঘুম। ঢাকায় এসে দেখেন সবই আছে নেই শুধু ব্যাগটি। তিনি বলেন, ব্যাগে টাকা ছিল ১১শ’র মতো। কিন্তু এটিএম কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলি। কি যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সেই সঙ্গে এই তিন কার্ড তোলার জন্য কয়েক মাস অফিসে অফিসে ঘুরতে হয়েছে।
প্রায়শই রাস্তাঘাটে দেখা যায় ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে মানিব্যাগ। দৈনন্দিন ব্যবহার্য এই পণ্যটির দাম কম হলেও গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম। একটি ফেসবুক গ্রুপে এক নারী জন্মদিনে স্বামীকে কী উপহার দেয়া যেতে পারে এই নিয়ে একটি পোস্ট দেন। যার অধিকাংশ উত্তর ছিল মানিব্যাগ। এখন আবার অনেকেই নাম লিখে, ছবিসহ মানিব্যাগ কাস্টমাইজড করে বানিয়ে নেন।
মানিব্যাগ বা টাকার থলে। সময়ের পালাবদলে বদলে যায় এর ধরন ও গড়ন। তবু নীরবে গুরুত্ব সহকারে আমাদের টাকা ধরে এই ব্যাগটি। এই মানিব্যাগ বা ওয়ালেটের উদ্ভাবন হয়েছিল লাঞ্চবক্সের বাহক হিসেবে। মানিব্যাগের ইতিহাস শুরু হয় সৈনিক বা যোদ্ধাদের হাতে যা সাধারণত তাদের বেল্টের সঙ্গে বেঁধে রাখা হতো সমরাস্ত্রের বিভিন্ন গেজেটসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার জন্য। আকারে কিছুটা বড় ধরনের সেইসব ওয়ালেটে সৈনিকরা সেসময় লাঞ্চবক্স এবং মুদ্রাও বহন করতেন। ঐতিহ্যগতভাবে গাভী বা ঘোড়ার চামড়া দিয়ে তৈরি হয় ওয়ালেট। প্রাচীন গ্রিকরা যে ওয়ালেট ব্যবহার করতেন তার নাম ছিল ‘ন্যাপস্যাকস’ এবং তা মূলত লাঞ্চবক্স বহন করার জন্যই ব্যবহৃত।
ফরাসিদের কাছে ‘লে পোর্তে-মন্নায়ে’ এবং স্প্যানিশ স্পিকারদের কাছে ‘লা কার্তেরা’ হিসেবে পরিচিত এই ওয়ালেট  ইংরেজদের কাছে মানিব্যাগ, পকেটবুক, পার্স বা বিলফোল্ড নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এটি ফ্যাশনের প্রতীক হিসেবে বিকশিত হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমরা যে মৌলিক বিষয়গুলো ক্রস চেক করি তার মধ্যে এই মানিব্যাগ অন্যতম।
ছেলেদের মানিব্যাগ বা ওয়ালেট আকারে ছোট হলেও বর্তমানে এটির আকার বড় হয়েছে। স্মার্টফোন রাখার জন্য এই মানিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। যার আকার মেয়েদের পার্সের সমান হয়েছে। আর মেয়েরা বর্তমানে অধিকাংশই টাকা রাখার জন্য ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতরে ছোট ব্যাগ বা পার্সে টাকা বহন করে থাকেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে মানিব্যাগ নিয়ে স্ট্যাটাসের নেই অভাব। মাসের শেষে ফাঁকা মানিব্যাগ নিয়ে আসে অনেক পোস্ট। স্ট্যাটাসের ভিড়ে একটা স্ট্যাটাস চোখে বাঁধলো। তার শুরুটা হলো পুরুষের মেরুদণ্ড মানিব্যাগ। দীর্ঘ স্ট্যাটাসের কয়েকটি লাইন এরকম- পুরুষের অসুখ বিসুখ হয় শরীরে, এটা ছোটবেলায় বিশ্বাস করতাম। এখন আর বিশ্বাস করি না, বাবার পথে হাঁটতে বের হয়ে জেনেছি পুরুষের মূলত অসুখ-বিসুখ হয় মানিব্যাগে। পুরুষের বিচার করা হয় কালো মানিব্যাগে। মানিব্যাগ অসুস্থ থাকলে সালিশ বিপক্ষে চলে যায়। মানিব্যাগ অসুস্থ থাকলে সত্যও মিথ্যা হয়ে যায়। মানিব্যাগ অসুস্থ থাকলে প্রিয়তমার কাছেও অসহ্য মানুষ। পুরুষ মানুষের মানিব্যাগ অসুস্থ থাকলে তামাম দুনিয়ার সব বিপরীতে হাঁটে।
মানিব্যাগ শুধুই একটি ব্যাগ নয়। এটি আপনার শক্তিমত্তার জায়গা। আপদে-বিপদে, প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে এই ব্যাগটি যত বেশি বের করা যায় ততই তিনি শক্তিশালী মানুষ। তবে এখন মানিব্যাগের স্বাস্থ্য ধরে রাখা খুবই কঠিন। একটা হাজার টাকার নোটে বাজারের থলেটাও যে ভরছে না। বাজারে ভীষণ চাপে মানুষ।
‘পকেটমার’ শব্দটির ব্যবহার হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। তবে বর্তমানে এর সংখ্যাটি কমেছে। এখন মানুষ মানিব্যাগ আর পেছনের পকেটে বহন করেন খুব কম। বর্তমানে প্যান্টের পকেট বড় হওয়ায় সামনের পকেটেই রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদনে একজন চোরের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। সেখানে চোরকে বলতে শোনা যায়, ২০১০ সাল থেকে ঢাকায় থাকে সে। প্রথমে বাসে, রাস্তাঘাটে ব্লেড দিয়ে পকেট কেটে মানিব্যাগ চুরি করতো। এখন পেছনের পকেটে মানিব্যাগ না রাখায় বদলেছে চুরির ধরন। এখন সে হাতে থাকা মোবাইল ফোন চুরি করে। বিশেষ করে কথা বলার সময় বাসের জানালা দিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। 
মানিব্যাগের চাপ নিয়ে ভিন্ন পেশার বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদিব হাসান বলেন, আমি এখন চতুর্থ বর্ষে। এখন মিলে ডিম থাকা যেন রিচ ফুড। ডিম দিয়ে মিল চালানোও দায়। ভার্সিটির শুরুতে নিয়মিত ব্রয়লার মুরগি খেতাম এখন এটা সপ্তাহে একদিন খাই। আগে মেসের জন্য মুরগি আনা হতো আড়াই থেকে তিন কেজির। এখন আনা হয় দেড় থেকে দুই কেজির। এতকিছুর পরও আমাদের মিলরেট আসে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। আগে যেটা ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। হ্যাঁ মানিব্যাগ তো চাপে আছেই।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে মিরপুরে থাকেন। বলেন, সংসার চালানো আমার জন্য এক মহা চ্যালেঞ্জ। আগে পান্থপথে দুই রুমের বাসা নিয়ে থাকতাম। ভাড়া পড়তো ১৮ হাজার টাকা। এখন মিরপুরে থাকি ভাড়া দেই ১২ হাজার টাকা। কিন্তু এখন বাজার করাটাই দায় হয়ে গেছে। এমন অবস্থা হয়েছে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকরি করি। এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে দুই তিন ঘণ্টা রাইড শেয়ার করি। এরপরও সংসার চালানো মুশকিল। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, খরচ বাড়ছে। একেবারে দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।
মিরপুরের একটি বাড়িতে নিরাপত্তার কাজ করেন ষাটোর্ধ ইসমাইল হোসেন। তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে গ্যারেজের ছোট এক কোণায় থাকেন। তিনি বলেন, মাসে বেতন পাই ১০ হাজার টাকা। আর বকশিশ পাই আরও দুই/তিন হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে চলাটা খুবই কষ্টকর। আমাদের দু’জনের ওষুধ লাগে মাসে চার হাজার টাকা। ঠিকমতো মাছ-মাংস কিনতে পারি না। খুব কষ্টে আছি। দিন দিন খরচ বেড়েই চলছে। আর কতো খরচ কমানো যায়?
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষে ঢাকায় চাকরি করছেন গোলাম রাসেল। তিনি বলেন, ভার্সিটি শেষ করে এখন একটা চাকরি করছি। এ দিয়ে আমি নিজেই চলতে পারি না। বাবা-মায়ের কাছে টাকা পাঠাবো কীভাবে? বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে চাপ আছে বরাবরই। এখন আমি চলতে পারি না- বিয়ে করবো এটা ভাবতেও পারি না। ধীরে ধীরে হতাশায় পড়ে যাই। আর মানিব্যাগের দিকে তাকালেই নিজেকে অসহায় লাগে।
চলতি বছরের জুন মাসে বিবিএস’র তথ্যানুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪। মানিব্যাগে চাপ বাড়ার আরও একটি বড় কারণ ঋণ। তিন বছরের ব্যবধানে দেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের অঙ্ক এক লাখ টাকা থেকে বেড়ে দেড় লাখ টাকা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে সিপিডি।

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক/ পিতা ও কন্যার পরিণতি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status