নির্বাচিত কলাম
রিসেট বাটন ও বিদ্যমান রাজনীতি
ডা. রফিকুর রহমান
৮ অক্টোবর ২০২৪, মঙ্গলবারসম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে- ‘ছাত্ররা বলেছে আমরা রিসেট বাটন পুশ করেছি, 'Everything gone', অতীত নিশ্চিত ভাবে চলে গেছে, এখন নতুন ভঙ্গিতে আমরা সব করে ফেলবো, দেশের মানুষও তাই চায়’।
স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী একটি মহল তার বক্তব্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তব্য বলে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন রিসেট বাটন পুশ করলেই অতীতকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। তারা বলার চেষ্টা করছেন অধ্যাপক ইউনূসের এই বক্তব্য স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অর্থাৎ তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধকে নিয়ে আমাদের যে অতীত গৌরব সেটাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেন।
‘রিসেট বাটন পুশ করা’ শব্দগুলো ইলেকট্রনিক ডিভাইস বিশেষ করে কম্পিউটারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শব্দগুলোকে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধরনের মেটাফোর রাজনীতির অঙ্গনে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় যেমন- ‘খেলা হবে’, ‘জনগণ লালকার্ড দেখাবে’, ‘রাজনীতিতে ছক্কা মেরেছে’ ইত্যাদি।
‘রিসেট বাটন পুশ করা’ শব্দগুলোকে যদি কম্পিউটার ব্যবহারের দিক থেকে বুঝি তাহলে দেখা যায় কম্পিউটারে যখন বিভিন্ন ভাইরাস, ম্যালওয়্যার আক্রমণ করে অথবা ফ্রিজিং হয়ে যায় তখন রিসেট বাটন চেপে কম্পিউটারের আগেকার ডিফল্ট সেটিংস-এ পুনরুদ্ধার করা হয়/সেটিংস-এ ফিরে যায়। অর্থাৎ যে অবস্থায় কম্পিউটারকে কেনা হয়েছিল সেই ফ্যাক্টরি সেটিংস-এ ফিরে যাওয়া হয়। তারপর আবার প্রয়োজনীয় সফ্টওয়্যার আপলোড করে নতুন নতুন কর্মক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়।
অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক কথোপকথনে রূপকটি ব্যবহার করে যথার্থই বলেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন রিসেট বাটন পুশ করে একদিকে যেমন পনেরো বছরের শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে এবং ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশকে তার ফ্যাক্টরি সেটিং এ ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য। বাংলাদেশের জন্য ফ্যাক্টরি সেটিং হচ্ছে দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় যার ভিত্তি ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়চিার। বাংলাদেশের প্রথম ম্যালওয়্যার আক্রমণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতার ঊষালগ্নে। তখন প্রয়োজন ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার‘। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাঙালির ঘাড়ে চেপে বসে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার।
পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে স্বাধীন দেশে সংবিধান রচনা এবং রাষ্ট্র গঠনে নানা ধরনের ভাইরাস এবং ম্যালওয়ার এমনভাবে প্রোথিত হয়েছিল যে যার ফলশ্রুতিতে বিগত ১৫ বছর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ জগদ্দল পাথরের মতো বাংলাদেশের মানুষের বুকের উপর চেপে বসেছিল। রিসেট বাটন পুশ করে মুছে ফেলা হয়েছে সেই কলঙ্কিত অধ্যায়গুলো, সেই ভাইরাস, সেই ম্যালওয়্যারগুলো যা বাংলাদেশকে গত পনেরো বছর একটা ফ্যাসিবাদী গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। গুম, খুন ও হত্যা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। রাষ্ট্রযন্ত্রের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং সর্বত্র গড়ে উঠেছিল ভয়ের সংস্কৃতি। বিরোধী মত এবং সক্রিয়তাকে আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় এবং পরিশেষে নিশ্চিহ্ন করা হতো। এই ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে একজন মানুষ সকালে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে সন্ধ্যায় নির্বিঘ্নে বাসায় ফেরাকে সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে মনে করতো।
ছাত্র-যুবসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পলায়ন করেন। এই গণঅভ্যুত্থান ছিল রক্ত দিয়ে কেনা। এতে ঝরে গেছে ১৫ শতাধিক প্রাণ, হাজার হাজার মানুষ হয়েছেন আহত, অনেকেই করেছেন পঙ্গুত্ববরণ। শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষ যেন নতুন করে মুক্তির স্বাদ পেলো, নতুন করে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা পেলো এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন জন্ম নিলো। গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন এবং মানবতাবোধসম্পন্ন নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় জনগণের মনে আশা বাঁধলো।
এখন প্রয়োজন গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে সময়োপযোগী নতুন নতুন সংস্কারের সফ্টওয়্যার এবং প্রোগ্রাম ইন্সটল করে বাংলাদেশকে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই এই সংস্কারের মূল কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার সে সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমাজের চাহিদা মোতাবেক সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই সংস্কারের কোনো শেষ সীমা নেই। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।
সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন চাহিদা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে সময়ে সময়ে সৃষ্ট হয়। আজকের বাস্তবতায় উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত এইসব শ্রেণি-পেশার মানুষজনকে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা রাষ্ট্রযন্ত্রকে করবে গণতান্ত্রিক ও গণমুখী এবং রাজনৈতিক দল ও জনগণকে গণতন্ত্রের আবহ কাঠামোকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সাহায্য করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর বাহিরে সমাজের বিভিন্ন অংশের শ্রেণি-পেশার মানুষের রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে প্রতিনিধিত্ব করা হবে সার্বিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই অদলীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি কখনো কখনো এতই শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় যা দলীয় রাজনৈতিক শক্তির সীমাবদ্ধতাকেও পেরিয়ে যায়। সম্প্রতি এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ অদলীয় সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির কাছে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও পলায়ন।
রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যক্তির কর্তৃত্ববাদিতা এবং পারিবারিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোনোক্রমেই পারিবারিক উত্তরাধিকার যেন রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের জন্ম না দিতে পারে সেক্ষেত্রে বিশেষ কাঠামো বা বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দল আসলে প্রকৃত বিবেচনায় রাজনৈতিক দল নয় বরং এদেরকে ‘পলিটিক্যাল কর্পোরেট কোম্পানি’- বলাই শ্রেয়। দলীয় প্রধান নিজেই CEO (Chief Executive Officer) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বড় বড় বাণিজ্যিক কর্পোরেট কোম্পানির মতো সারা বছর ধরে চলে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের পদগুলোতে নেতা-কর্মীদের নিয়োগ এবং অপসারণ। অর্থাৎ দলীয় প্রধান কোম্পানির ঈঊঙ’র মতো হায়ারিং অ্যান্ড ফায়ারিং করে থাকেন ছোট-বড় সকল পদে। দলীয় প্রধানের ইচ্ছায় হয়তো উচ্চ কোনো পদে তাদের চাকরি হয় আবার তারই ইচ্ছায় অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয় বা নিষ্ক্রিয় করা হয়। রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য কখনো এ রকম হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। দলীয় সংস্কারের মাধ্যমেও এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হওয়া খুবই জরুরি।
রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যই পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউশন হিসেবে কাজ করবে। দলীয় নেতা-কর্মীরা সেখান থেকে শিক্ষা লাভ করবেন দলীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য। নেতা নির্ধারিত হবেন সবকিছু মিলিয়ে দলের ভিতরে যোগ্যদের মধ্য থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। তাহলেই কেবল দেশ এবং জাতি সেই দল এবং নেতৃত্ব থেকে উপকৃত হবে।
নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অদলীয় এবং দলীয় রাজনীতি চর্চায় গণতান্ত্রিক হতে না পারলে কোনো ব্যক্তি কখনোই রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক হতে পারেন না ।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক