অনলাইন
‘মানুষ কেন মানুষ মারে’
আবু এন এম ওয়াহিদ
(২ সপ্তাহ আগে) ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবার, ১২:০৯ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৬ পূর্বাহ্ন
বেশ কয়েক বছর আগের কথা।‘মানুষ কেন মানুষ মারে’ এই শিরোনামে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। লেখাটা পড়ে আমি আমার ইংল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু মাহবুবুকে ফোন করি। টেলিফোনে এ নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তারিত আলাপ হয়। সুনীল বাবুর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই নিবন্ধের অবতারণা। তবে এখানে কিছু কিছু বিষয়ের সূত্র মাহবুবের কাছ থেকে পাওয়া, আর তাই তার প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রচনাটা শুরু করছি। দার্শনিক ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যথার্থই প্রশ্নটা তুলেছেন। লেখাটা পড়ে তাৎক্ষণিক আমার মনে হয়েছিল, হঠাৎ ওই লেখকের মনে এই পুরনো প্রশ্নটা নতুন করে কেন জেগে উঠল? আর উঠলই যখন তখন তিনি কেন বিষয়টার আরো গভীরে গেলেন না?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সংক্ষেপে যা লিখেছিলেন তার মর্মার্থ দাঁড়ায় এরকম, অন্য প্রজাতির জন্তু জানোয়ারেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করলেও তারা একজন আরেকজনকে কখনো প্রাণে মারে না। আমরা জানি - কাকের মাংস কাক খায় না। বাঘ, বাঘকে খুন করে না। এমন কি একটা পিঁপড়াও আরেকটা পিঁপড়াকে কখনো বধ করতে উদ্যত হয় না। আহার নিয়ে ক্ষুধার্থ দুই কুকুর কাড়াকাড়ি করে। কামড়াকামড়িও করে। লড়াই শেষে যার গায়ে জোর বেশি সেই খাবারের দখল নেয়। দুর্বল কুকুর লেজ গুটিয়ে পালায়। এখানেই তাদের মধ্যকার সংঘাতের স্থায়ী মীমাংসা হয়ে যায়। একটা আরেকটাকে হত্যা করে না। করার প্রয়োজনও পড়ে না।
এছাড়া বিপরীত লিঙ্গের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও পশুকুলে অহরহ ঝগড়াঝাটি হতে দেখা যায়। কিন্তু কোনো সময়ই তা খুনখারাবি পর্যন্ত গড়ায় না। এখানেও দৈহিক শক্তিবলে একটা জিতে। অন্যটা হেরে রনে ভঙ্গ দেয়। ওই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে লেখক আরো বলেছিলেন, একই ধরনের দ্বন্দ্বে, মানুষ পশুর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র হতে পারে। বাইবেল থেকে তিনি মানবজীবনের সূচনালগ্নে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের উদাহরণ টেনে এনেছিলেন। আমরা অনেকেই জানি, হাবিল-কাবিলের কথা মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনেও আছে।
এবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্যের পরিধিকে বাড়িয়ে বিষয়টার আরেকটু গভীরে যেতে চাই। দেখতে চাই, মানুষের স্বজাতি নিধনের ডালপালা কতদূর বিস্তৃত ও প্রসারিত হতে পারে। পেটের খিদে ও যৌন প্রতিযোগিতায় প্রাণিকুলে স্বজাতির মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়। সংঘাতও বাঁধে। কিন্তু মানুষের মতো একটা আরেকটাকে হত্যা করে না। এর দু’টো কারণ থাকতে পারে। প্রথমতঃ যে বিষয়েই ঝগড়া হোক না কেন, এক পশুর প্রতি স্বজাতি আরেক পশুর একটা ন্যুনতম মমত্ববোধ বা দরদ থাকে। এজন্যে তাদের মারামারিতে একটা প্রাকৃতিক সীমারেখা টানা হয়ে যায় এবং তারা সচেতনভাবে কোনো সময়ই সেই লাল রেখা অতিক্রম করে না। এটা যদি ঠিক হয়, তাহলে পশুকুল অবচেতন বা অবুঝ নয়। আর তা যদি না হয়, তাহলে দ্বিতীয়টাই ঠিক, অর্থাৎ তারা স্বভাবজাতভাবেই মানুষের চেয়ে কম হিংস্র। কারণ তাদের লড়াইয়ের শেষ পরিণতি কখনো মানুষের মতো এত বীভৎস, এত মারাত্মক, এত ধ্বংসাত্মকএবং আত্মঘাতীহয় না। যেভাবেই দেখি না কেন, বিষয়টি সভ্য মানবকুলের জন্যে যে সম্মানসূচক নয় তা বলাই বাহুল্য।
এ ছাড়া মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াইয়ের পরিধিটা পশুকুলের চেয়ে আরো অনেক গভীরে প্রোথিত ও প্রসারিত। মানুষে মানুষে সংঘাত শুধু বিত্ত-বৈভব ও নারীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যেই হয় না। হয় আরো অনেক কারণে। যেমন সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষের সাথে চলছে মানুষের নিরন্তর লড়াই। এ লড়াইয়ে অনেক সময় একজন আরেকজনকে বধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতার মূল উৎস রাজনীতি। তাই রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ঘটে অনেক ষড়যন্ত্র এবং খুনখারাবি। এ ছাড়াও, মানুষ যদি মনে করে কারো কারণে তার মানসম্মান অথবা সুনাম বর্তমানে নষ্ট হচ্ছে কিংবা ভবিষ্যতে হতে পারে, তবে সে তাকেও হত্যা করতে প্রবৃত্ত হতে পারে। মানুষের মধ্যে ভাড়াটে খুনিও থাকে। টাকার বিনিময়ে একজনের নির্দেশে ওই জাতীয় খুনিরা সহজেই আরেকজনকে নিধন করে ফেলতে পারে। তবে এরও চূড়ান্ত লক্ষ্যের মধ্যে অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, মানসম্মান ও নারীই প্রধান। মানুষ স্রেফ রাগের বশবর্তী হয়েও মানুষকে মেরে ফেলতে সচেষ্ট হয়। তবে রাগেরও মূল কারণ হতে পারে টাকাপয়সা, জমিজমা, সম্ভ্রম, কিংবা এজাতীয় কোনো অনুষঙ্গ। অনেক সময়ে মানুষ মদ-গাঁজা খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে সামান্য কারণেও প্রতিপক্ষের প্রাণ হরণ করতে পারে। অনিচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা বশতঃও মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যু অসম্ভব নয়। মিল কারখানা ও রাস্তাঘাটে যন্ত্রযান চালাতে গিয়েও একজন আরেকজনকে মেরে ফেলতে পারে। মনুষ্যকূলে আরেকটি ঘটনা ঘটতে পারে - পশুকুলে যার কোনো আশঙ্কা নেই। কিছু কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত লোক উদ্দেশ্যহীনভাবে অকারণেও মানুষ মারতে পারে।
পশুর সাথে পশুর লড়াইয়ের মীমংসা হয় কেবলমাত্র দৈহিক শক্তির ভিত্তিতে, অর্থাৎ যে দুর্বল সে সবলের কাছে হেরে পালিয়ে যায়। নতুন করে লড়াইয়ের জন্যে ফের ঘুরে দাঁড়ায় না। কিন্তু মানুষের মধ্যকার সংঘাতে জয়-পরাজয়ের মীমাংসা শুধু গায়ের জোরেই হয় না। এখানে আরো বিবেচ্য বিষয় আছে। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী। সে শরীরে দুর্বল হলে পালিয়ে যাওয়ার পরও নতুন বুদ্ধি এঁটে সবলকে হারাবার নিমিত্তে নতুন উদ্যমে নতুন ফন্দি নিয়ে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে আবার আক্রমণ রচনা করতে পারে। পশুর বেলা বুদ্ধিবৃত্তিক পুনরাক্রমণের কোনো অবকাশ থাকে না। এখানে আরেকটা ব্যাপার থাকতে পারে। মানুষের স্মৃতিশক্তি অনেক তীক্ষ্ণ। তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী। শক্তিমান প্রতিপক্ষের কাছে দুর্বল মানুষটা প্রথমবার হেরে গিয়ে পশুর মতো পালিয়ে গেলেও সে পরাজয়ের কথা, বেদনার কথা, অপমানের কথা সহজে ভুলে না। আর ভুলে না বলেই সে নতুন করে লড়াই পরিকল্পনা নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। যেহেতু দুর্বল একাজ করতে পারে তাই সবল তাকে আগেই হত্যা করারও চেষ্টা করে এবং অনেক সময় সফলও হয়।
আরেকটা ব্যাপার আছে বাইবেল এবং কোরআনে যার যোগসূত্র পাওয়া যায়। মানুষের পেছনে ক্রমাগত কাজ করে যায় শয়তান বা ইবলিস। শয়তানের ধর্মই হচ্ছে মানুষকে খারাপ কাজে কুমন্ত্রণা দেওয়া ও ভালো কাজ থেকে দূরে রাখা। খুনখারাবি একটি জঘন্য অপরাধ। এটা শয়তানের খুব প্রিয় কাজ। সে এমন কাজে সর্বদা মানুষকে প্ররোচিত করে থাকে। কোনো কোনো সময় সফলও হয়। শয়তান যখন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে বেরিয়ে আসে তখন সে আল্লাহর কাছে এই শক্তি চেয়ে নিয়েছে যাতে সে সব সময় মানবসন্তানকে খারাপ কাজে কুমন্ত্রণা দিতে পারে। প্রভাবিত করতে পারে। জন্তু-জানোয়ারের পেছনে লাগার জন্যে শয়তান এমন বর আল্লাহর কাছে চায়নি। পায়ওনি।
পশুর পাশবিকতার সঙ্গে মানুষের হিংস্রতার আরেকটা বড় পার্থক্য আছে। মনুষ্যসন্তান পশুকুলের চেয়ে অনেক বেশি সমাজবদ্ধ জীবন-যাপন করে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করে। মানুষ ব্যক্তিগত ও সাষ্টিক পর্যায়ে অন্তর্গতভাবে বৈষয়িক ও স্বার্থপর। তাই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যখন-তখন স্বার্থের দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো সময় এ নিয়ে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বিধ্বংসী যুদ্ধ বেঁধে যাওয়াও অসম্ভব নয়। যুদ্ধে স্ব স্ব দেশের সীমানা রক্ষা করা যার যার সেনাবাহিনীর পবিত্র দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। এ জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এক দেশের সেনাবাহিনী আরেক দেশের সৈন্যদের এমন কি বেসামরিক জনগণকেও হত্যা করতে পারে। এতে দেখা যায় মানুষ যেমন বদ মতলবে মানুষ মারতে পারে তেমনি আবার সৎ ও মহৎ কারণেও মানুষের প্রাণ সংহার করতে দ্বিধা করে না। পশুদের মধ্যে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
পবিত্র কোরআনের সূত্র ধরে আরেকটা কথা বলা যায়। আল্লাহ পশুকে এমন স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, তারা সবসময়ই পশুর মতোই আচরণ করে। পক্ষান্তরে মানুষকে তিনি বানিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ অবয়বে। মহৎ গুণাবলী দিয়ে। তথাপি সময় সময় সে পশুর মতো আচরণ করতে পারে। আবার কখনোবা জেদ মেটাতে পশুর চেয়েও অনেক নিচে তার অবনমন ঘটাতে পারে।
সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। মানুষ শত্রু নিধনের অকল্পনীয় ও সীমাহীন শক্তি সঞ্চয় করেছে। তারা এখন একটি মাত্র বোমা-বিস্ফোরণে হাজার হাজার এমনকি লক্ষ লক্ষ মানুষও মেরে ফেলতে পারে। আজকাল রিমোট ডিভাইসের মাধ্যমে কোলেটারেল ড্যামেজ ছাড়াও কোনো বিশেষ সময়ে, বিশেষ জায়গায়, বিশেষ টার্গেটকে নীরবে উড়িয়ে দেওয়া যায়। এগুলো পরিচালিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে। রাষ্ট্রীয় খরচে। তবে জঘন্য গণহত্যা ও নগ্ন গুপ্তহত্যার সব কলা-কৌশল শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ বয়ে আনবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মানুষ-মারার ‘মহোৎসব’-এর এই নতুন মাত্রার কথা আমাকে ধরিয়ে দিয়েছেন আমার অগ্রজতুল্য বন্ধু, অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক আনিসুল ইসলাম।
এই আলোচনাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গেছেন মিশরীয় কৌতুকাভিনেতা বাসাম ইউসুফ। তিনি বলছেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁরা অল্প সময়ে সহজে অধিক মানুষ মারতে পারে তাঁর জন্যে কেবল মারাত্মক মারণাস্ত্র আবিস্কার করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। বিশ্বজনমত নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তারা অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে আরো কয়েকটি কাজ করেছে। তারা প্রথমে অপবাদ ও অপমান সহকারে শত্রুদের একটি অপ-নাম কিংবা বদ-নাম দিয়ে থাকে। তারপর খারাপ নামধারীদের নিধন করার অযুহাত হিসেবে মনগড়া একটি চমকপ্রদ আখ্যান (Narrative) তৈরি করে। ‘ওরা ‘খারাপ মানুষ’। ওরা ‘অমানুষ’। ওদের মারাই যায়।’ এ প্রসঙ্গে বাসাম ইউসুফ আরো কঠিন ও চমৎকার একটি কথা বলেছেন। যারা শত্রুর নামে মানুষ মারছে তারা জানে না, ‘প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের আপন মনুষ্যত্বকেই নিরন্তর বলি দিয়ে যাচ্ছে।’
পুনশ্চ: সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি-ঔপন্যাসিক Ñ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশ্নের যে উত্তর ও ব্যাখ্যা আমি দেওয়ার চেষ্টা করেছি তার সবটুকু আমার নিজের নয়। কিছু আমার। কিছু এখান-ওখান থেকে কুড়িয়ে তোলা। সে যাই হোক, সুনীলবাবু বেঁচে থাকলে কি তিনি আমার এ বিশ্লেষণের সঙ্গেসহমত পোষণ করতেন? আপনাদের কী মনে হয়?
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ। Email: [email protected]
পাঠকের মতামত
মানুষ, মানুষ মারে মানসিক খুদায় !
মানুষ যদি মানুষ মারে; তবে ওরা মানুষ না রে......
How to stop this unwanted killing between human beings..One of worst side human creatures..
অপূর্ব উদাহরণ দিয়ে লেখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। এই লেখা পড়ে অনেকের ঘুমন্ত বিবেক জাগ্রত হবে।