ঢাকা, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ

তোষামোদ নয়, উন্নয়নে প্রয়োজন দেশপ্রেম

প্রণব মজুমদার
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, রবিবারmzamin

দেশ থেকে টাকা পাচার ১৬ বছর ধরে নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দেশের ‘দেশপ্রেমিকগণ’ টাকা পাচার করতে শুরু করেন। বৈশ্বিক আর্থিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গড়ে প্রতি বছর ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বড় অংশই দেশ থেকে পাচার হয়। পাচার হওয়া গন্তব্য দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড।


আমাদের অনেক প্রভু! দেশে কিংবা বিদেশে। আপাতত বিদেশি প্রভুদের নিয়েই বলি। বিদেশি প্রভুরা আমাদের পরামর্শ দেন। উপদেশ দেন। খবরদারি তো আছেই! তাদের উপদেশ দেয়ার সংস্কৃতি দেশ জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি। দীর্ঘ সাড়ে চার যুগের অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার বদৌলতে প্রভুদের প্রকৃতি বুঝতে পেরেছি। ঋণের শর্ত হিসেবে কোন খাতে ভর্তুকি কমাবো বা প্রত্যাহার করে নেবো, শুল্কনীতি কী হবে, সেবাপণ্যে কোথায় বৃদ্ধি করবো এসব শর্ত আমাদের সরকারগুলোকে মানতে হয়। বিদেশি প্রভুরা আমাদের দেন কম; নিয়ে যান বেশি। সাম্রাজ্যবাদী স্ব্বরূপও তেমন। সহকর্মী প্রয়াত প্রবীণ প্রতিবেদক প্রফুল্ল কুমার ভক্ত দৈনিক সংবাদে লিখলেন- ‘বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংকের ভাবী!’ নব্বইয়ের দশকে এমন প্রতিবেদন মন্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে রসালো এবং হাস্যকর মনে হয়েছিল! পরে দেশের সচেতন মানুষ মন্তব্যটিকে সত্য বলেই ভেবেছে। 


আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধের পথে কেন যেন হাঁটতে পারে না! সফরকৃত যুক্তরাষ্ট্রের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের চেয়ার অ্যালেক্স সোরোস ও প্রেসিডেন্ট বিনাইফার নওরোজির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ক’দিন আগে বৈঠক করেন বর্তমান সরকারপ্রধান। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, উত্তরাধিকারসূত্রে তার সরকার বিপর্যস্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি অর্থনীতি পেয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে তথ্য তুলে ধরেন। তা ফিরিয়ে আনার জন্য ‘সম্পদ শনাক্তকরণ’ কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশকে সহায়তা করার অনুরোধ জানান।

দেশ থেকে টাকা পাচার ১৬ বছর ধরে নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দেশের ‘দেশপ্রেমিকগণ’ টাকা পাচার করতে শুরু করেন। বৈশ্বিক আর্থিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গড়ে প্রতি বছর ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বড় অংশই দেশ থেকে পাচার হয়। পাচার হওয়া গন্তব্য দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, অষ্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
শুধু ব্যক্তি উদ্যোগেই নয়, অর্থপাচার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে দেশের একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বেসরকারি ব্যাংকও। দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, গেল প্রায় দেড় যুগে দেশীয় ১৯টি ব্যাংকে আত্মসাৎ করা মাত্র ২৪টি ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমেই প্রায় একশ হাজার কোটিরও বেশি টাকা পাচার হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আর্থিক খাতে সংস্কারের কাজ শুরু হয়। সে ধারাবাহিকতায় বিগত ১৬ বছরে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিরুপণের উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক বছরে অর্থপাচার বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। টাকা পাচারের বিষয়টিকে অর্থনীতিতে ক্ষতিকর ‘টিউমার’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় প্রতিবেদনে। বলা হয়, বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতি ও সম্পদের বড় অংশ এই ক্ষতিকর টিউমার চুষে নেয়। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে, প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশের পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও প্রবাস আয় থেকে যত অর্থ এসেছে, এর এক-পঞ্চমাংশ পরিমাণ অর্থ এক বছরে পাচার হয়। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে যত অর্থ আসে, এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। সার্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। এতে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার শঙ্কার কথা বলা হয়। ৩৯৭ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে ২২টি ক্ষেত্রে আলোকপাত করা হয়। শ্বেতপত্রে বলা হয়, টাকা পাচারের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের ক্রীড়নক, আমলাদের মধ্যে একধরনের অনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে। ঘুষ-দুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপিঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়।

অর্থপাচার নিয়ে গবেষণা করে, এমন কিছু আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ৫৩২টি বাড়ি বা সম্পদ আছে, যার মূল্য সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার। ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে মনোনীত হয়েছেন। ২০২৩ সালে ইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮১৫ কোটি ডলার পাচার হয়।
সরকারি বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে, তাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎ অবকাঠামো, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় হয়েছে। এ থেকে ঘুষ হিসেবেই দিতে হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ঘুষ নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাদের সহযোগীরা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঘুষের টাকার মধ্যে ৭৭ হাজার থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা গেছে আমলাদের কাছে। রাজনৈতিক নেতা ও তাদের সহযোগীদের কাছে গেছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। আর ঠিকাদারেরা দেশে ও বিদেশে এ অর্থ পৌঁছে দিয়েছেন রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে। তাদের বড় অংশ থাকেন বিদেশে। 

প্রধান উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন যে বিপর্যস্ত অর্থনীতি আমাদের। বলতেই হয়, ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাজুক অবস্থা। পুঁজিবাজার পতনবৃত্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। রফতানির চাকা ঘুরছে না। বিনিয়োগ আশাব্যঞ্জক নয়। শুধু প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছাড়া দেশ অর্থনীতির সকল সূচকই নিম্ন্নমুখী। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে তো বাড়ছেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে যা পরিবহন খরচ বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করবে। এতে প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যের ওপর।
দুর্নীতিতে বিশ্বে আমরা শীর্ষস্থানে ১৬ বছর ধরে নয়। আগেও আমরা এ জন্য বিশ্বদরবারে বেশ সমালোচিত ছিলাম। ৫৩ বছরে এ পর্যন্ত দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে তার হিসাব বের করা জরুরি। দেশের ব্যাংক লুট করে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে দেশপ্রেমিকেদের জমাকৃত সে অর্থ বের করে নিয়ে আসা যায় না কি?

দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। নিজ স্বার্থরক্ষায় কাজ করি। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও। হালুয়া-রুটির ভাগাভগি। আখের গোছানো আমাদের ধর্ম। 
অর্থনীতিতে অমিত সম্ভাবনার সুজলা সুফলা সোনার বাংলাকে বঞ্চিত করে বিদেশকে আমরা ভালোবেসেছি। সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় বাড়ির মোহ দেশকে উন্নতির পথে নেয়নি মোটেও।  প্রভু দাতাদের তোষামোদ করছি; বিদেশি ঋণে নিজেদের দায় ভারী করছি। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারিকরণের নামে বিশৃঙ্খলিত করেছি। বিনিয়োগের নামে অনাবাসী বাংলাদেশি এবং প্রভুদের নানা ধরনের সহায়তাদানের নীতি দেশের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করেছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক
[email protected]

 

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status