অনলাইন
কাওরান বাজারের চিঠি
আছিয়া, আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি
সাজেদুল হক
২১ মার্চ ২০২৫, শুক্রবার
২০ বছর পেশায় আছি। লিখেছি বিচিত্র সব বিষয়ে। আনন্দ-বেদনার এক মহাকাব্য। কখনো কখনো খুব ক্লান্তি লাগে। সব ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের হওয়া লাশের পা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। এই তো সেদিন জুলাই-আগস্টে আমাদের সন্তানদের, ভাই-বোনদের খুন হতে দেখেছি। অনেক দিন ঠিকঠাক ঘুমাতে পারিনি। এখনো মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি।
স্থিতিশীলতা বলতে যা বুঝায় দেশে আজও তা ফেরেনি। প্রতিবেশী দেশের মিডিয়া প্রতি মুহূর্তে গুজব উৎপাদন করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা। এরই মধ্যে আছিয়ার ভয়ঙ্কর খবর নজরে আসে। পুরো খবরটা পড়ি না। হৃদয় থেকে প্রার্থনা করি মেয়েটা অন্তত বেঁচে যাক। কিন্তু আঁচ করতে পারি, খুব একটা আশা নেই।
বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে সে ভয়ঙ্কর খবর পাওয়া যায়। আছিয়া নেই। নেই মানে আর নেই। সেনা হেলিকপ্টারে শেষবারের মতো তার নিথর দেহ বাড়ি ফেরে। আমি পালিয়ে থাকি। এ নিয়ে কিছু লিখতে, বলতে ইচ্ছা করে না। মানুষ কী করে এত বর্বর হয়? প্রশ্নটা অনেকবারই মনে আসে। কল্পনাতেও উত্তর পাই না। কোনো সমাধানও পাই না। আট বছরের এক ছোট্ট শিশু। তার ওপর কী করে এমন বর্বর, অমানবিক নির্যাতন চালাতে পারলো। এরা কি সেই মানুষ যারা পশুর চেয়েও নিষ্ঠুর।
মানবজমিনের জন্য হেডলাইন ভাবতে থাকি। সাংবাদিকতায় নিষ্ঠুর কাজ। শেষ পর্যন্ত একটা স্থির করি, ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত বাংলাদেশ।’ সন্ধ্যায় মতি ভাইর (মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন) সঙ্গে আলাপ করি। মতি ভাই জানতে চান, ‘এটা নিয়ে কি আপনি লিখছেন?’ আমি তেমন কিছু বলি না। আসলে লিখতে ইচ্ছা করে না। কিছুক্ষণ পর কাজল দা (কাজল ঘোষ, নির্বাহী সম্পাদক জনতার চোখ, বার্তা সম্পাদক মানবজমিন) জনতার চোখ-এর জন্য আছিয়াকে নিয়ে লিখতে বলেন। আমি আবার আঁতকে উঠি। রাতের একটা বড় অংশ ভাবি কী লিখা যায়।
নজরে আসে কবি ফারুক ওয়াসিফের লেখা। তিনি লিখেছেন-
আছিয়ার আজান শোনো
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখি, পাখি দেখি, প্লেন দেখি।
আছিয়াকে দেখি না। কেবল ভালুকের খোলস পরা রোমশ রাজনীতি দেখি। আমি আর আকাশের আশ্বাসে বিশ্বাস রাখি না।
আমি বিশ্বাস করি না, শিশুরা তারা বা পাখি হয়ে যায়। সামরিক হেলিকপ্টারের শব্দ কি তাদের ভালো লাগে? এভাবে কি কেউ বাড়ি ফেরে?
আমার বুকটা খুব ফাঁকা লাগছে। সর সর করে বালি সরে যাচ্ছে পায়ের তলে। আমি আমার মেয়েটাকে বুকে জড়াই, তবু ভয় কাটে না।
তোমার জরায়ুতে একটা শোকের পাথর বসে যাচ্ছে দেখে, আমি তাকাতে পারি না। যদি আমার দৃষ্টি পড়া মাত্রই সব নারীর চোখ পাথর হয়ে যায়!
আমিও পিতা, আমার বুকেও জমে বেদনার নিকষিত দুধ। কালো দুধের অশ্রু উঠে আসে আমার চোখে। আমার চোখ আজ তিস্তা নদীর মতো পাহাড়ি রাগ হয়ে বাজছে। আজ আর কথা হবে না। আজ আমরা আছিয়ার আজানে শামিল জানাজায়।
আজ মা আছিয়া একটু ঘুমাবে। কেবল মাটি, কেবল মাটি ছাড়া আমার মেয়েটার কোনো মা নাই আজ।
ফেসবুকেই ইসলামী বক্তা মাওলানা আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ লিখেছেন, ‘আম্মু, আছিয়া, তুমি এমনভাবে ‘বেঁচে গেলে আজ’ যে আমরা হাজারবার মরেও তার দায় শোধ করতে পারবো না। আমি তোমার জন্য অঝোরে কাঁদছি, মা’রে! জানি, পুরো দুনিয়ার সবার চোখের সব পানিও তোমার এ দুঃখের ভারের কাছে এক ফোঁটারও সমান হতে পারে না। ওহহ! ভুলে গেছি বলতে আমরা কিন্তু সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার করবো, হুঁ! কত্ত বিচার আগেও আমরা করেছি!’
এই সব লেখা পড়ি আর ভাবি কী লেখা যায়! আছিয়া আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বাংলাদেশকে সে তাড়িয়ে বেড়ায়। এমনকি কেন যেন মনে হয় পুরো মানব সভ্যতাকে সে তাড়িয়ে বেড়ায়।
আবার বলি? আট বছরের একটি শিশু। তার সঙ্গে যখন এ বর্বরতা চলছিল কী ভাবছিল সে! অবিশ্বাস্য, অমানবিক। কোনো শব্দ দিয়েই তো এর ব্যাখ্যা করা যায় না। পৃথিবীতে সেই শব্দ আজও আবিষ্কার হয়নি।
কেন কিছু মানুষ নামধারী লোক এতটা অমানুষ হয়ে গেল? আইনের শাসন এখানে একটি বড় প্রশ্ন। সমাজে যখন দেখা যায় অপরাধীরা অর্থের জোরে, প্রতিপত্তির জোরে আইনকে অবজ্ঞা করতে পারে, অপরাধ আড়াল করতে পারে তখন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে আইনের শাসনের ক্ষেত্রে একটি বিরাট বিপর্যয় ঘটে গেছে। আমরা এখানে দেখছি বড় বড় অভিযুক্তরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। আছিয়ার মর্মান্তিক ধর্ষণ, হত্যার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম আইনের সঠিক এবং নিরপেক্ষ প্রয়োগ করতে হবে। অপরাধীকে সর্বোচ্চ সাজা দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দ্রুত এ মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে আমাদের রাষ্ট্র নানা রকম উদ্যোগ নেয়, বাৎচিত করে। আবার সোশ্যাল মিডিয়া যখন চুপ হয়ে যায়, রাষ্ট্রও চুপ হয়ে যায়। যে কারণে অপরাধীরা সবসময় বিচারের মুখোমুখি হয় না। সবক্ষেত্রেই অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
সমাজে নৈতিকতার স্খলন হয়েছে ভয়ঙ্কর। শুধু আইন দিয়ে এসব অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যক্তিদের আরও সোচ্চার হতে হবে।
আছিয়াকে নিয়ে লেখা সত্যি কঠিন। সান্ত্বনা জান্নাতে সে ভালো থাকবে। আর ধর্ষক আর খুনিদের জন্য নিশ্চয় অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি।
পবিত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আমার কথাই সত্যে পরিণত হবে যে, নিশ্চয় আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবো মানুষ ও জীন উভয় দ্বারা।’ সূরা আস সাজদাহ।
সূত্র- জনতার চোখ
পাঠকের মতামত
Pl open a Foundation office first anywhere..that will be in the name of ASHIA ...thanks.
কোরআন দিয়ে বিচার করলে সঠিক বিচার পাওয়া যাবে অন্যথায় বিচার সুষ্ঠু হবে না।