বিশ্বজমিন
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
ট্রাম্পের অসংলগ্ন বাণিজ্য নীতি স্থায়ী ক্ষতি করবে
মানবজমিন ডেস্ক
(৩ সপ্তাহ আগে) ১২ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ১০:০৫ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫২ অপরাহ্ন

৯ই এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার সবচেয়ে অযৌক্তিক এবং ধ্বংসাত্মক শুল্ক আরোপের পর আর্থিক বাজারে ব্যাপক মন্দা দেখা দেয়। আমেরিকান স্টকের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক শতকরা ৯.৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এই পরিমাণ প্রায় ১৭ বছরের মধ্যে দৈনিক বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার। এরপরই সেই শুল্ক নীতি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন। এর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অন্ধকার পরিস্থিতি কল্পনা করেছিলেন। এক সপ্তাহ আগে ট্রাম্পের ‘পারস্পরিক’ শুল্ক ঘোষণার পর যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তার পরে তা স্থগিত করা বিশ্বের জন্য স্বস্তির কোনও ছোট বিষয় নয়। এমন মন্তব্য করে দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিন্তু দুর্যোগ এড়িয়ে যাওয়ার সান্ত্বনাকে সৌভাগ্য ভেবে ভুল করবেন না। ট্রাম্প বিশ্ব বাণিজ্যে যে ধাক্কা দিয়েছেন, তা এখনও ইতিহাসে দেখা যায়নি। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আমেরিকা যে স্থিতিশীল বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তার পরিবর্তে তিনি অদ্ভুত এবং স্বেচ্ছাচারী নীতি নির্ধারণের ব্যবস্থা করেছেন। তার সিদ্ধান্তগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়েছে। এমনকি তার উপদেষ্টারাও জানেন না যে, পরবর্তীতে কী ঘটছে।
তিনি এখনও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের সাথে এক অসাধারণ বাণিজ্য সংঘাতের মধ্যে রয়েছেন। সর্বত্র বিনিয়োগকারী এবং কোম্পানিগুলি বিপাকে পড়েছে। ট্রাম্পের প্রথম শুল্ক ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী বাজারগুলি ভেঙে পড়ে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ কমেছে। হেজ ফান্ডগুলো তাদের লিভারেজড পজিশনগুলো খুলতে বাধ্য হয়েছে। এতে দীর্ঘদিনের ট্রেজারি বিক্রি হয়ে গেছে। ডলারের দাম পড়ে গেছে। শুল্ক বিলম্বিত হওয়ার পরে স্টক মার্কেটগুলোতে উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। এনভিডিয়াতে দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মূল্যের মধ্যে উঠানামা করেছে ৪৩০ বিলিয়ন ডলার। শুল্ক স্থগিতের পরেও ট্রেজারি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। বৈশ্বিক স্টক ফেব্রুয়ারিতে তাদের সর্বোচ্চ সূচকের চেয়ে শতকরা ১১ ভাগ কমেছে। ট্রাম্প জানুয়ারি থেকে আমেরিকার গড় শুল্ক হার শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি বাড়িয়েছেন। ভবিষ্যতে ওষুধ আমদানিসহ আরও শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার উপদেষ্টারা অর্থনীতিতে শুল্ক যে ক্ষতি করতে পারে সে সম্পর্কে এক ধরণের অনীহা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, শুল্ক এবং বাজার পতনের জন্য বিদেশীরা দায়ী। তাদের মতে, শুল্ক এবং বাজার পতনের জন্য কেবল ধনী বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হবে। তবুও ডলারের পতন নিশ্চিত করে যে, শুল্ক আমেরিকান ভোক্তাদের খরচ বৃদ্ধি করবে। এটা পরিবারের প্রকৃত আয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
মূলধন খরচের ক্ষেত্রেও একই রকম আঘাত আসবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিত হতে চায় যে, বিশ্ব বাণিজ্যের নিয়ম স্থিতিশীল থাকবে, যাতে তারা তাদের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদিও ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) চীনের যোগদানের ফলে বাণিজ্যের বিস্ফোরণ ঘটে, তবে এতে আমেরিকার সাথে বাণিজ্য বাধা বস্তুগতভাবে কমানো হয়নি। পরিবর্তে, ব্যবসাগুলো আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিল যে- কোনও বাণিজ্য যুদ্ধ হবে না। ট্রাম্প এখন আমেরিকা এবং তার বাণিজ্য অংশীদার উভয়ের জন্যই সেই আস্থার জায়গাকে বিপরীত করে দিয়েছেন- বিশেষ করে যেহেতু তার শুল্ক আমেরিকার অতীত বাণিজ্য চুক্তিগুলিকে উপেক্ষা করেছে। এর মধ্যে তিনি তার প্রথম মেয়াদে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলিও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ট্রাম্প তার ৯০ দিনের মেয়াদে আসলে কী অর্জন করতে চান তা এখনও স্পষ্ট নয়: অন্যান্য দেশ থেকে ছাড় আদায় এবং উৎপাদন কর্মসংস্থান পুনঃর্নির্ধানরনে তার স্পষ্ট লক্ষ্যগুলো একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক। যদি শুল্ক কমানো হয়, তাহলে পুনঃনির্ধারণ ঘটবে না। তবুও যদি বাণিজ্য অংশীদাররা সন্দেহ করে যে, তিনি সুরক্ষাবাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ- তাহলে তারা কেন ছাড় দেবে? এমনকি যদি সমস্ত শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়, তবে ‘মুক্তি দিবস’-এর স্মৃতি সরবরাহ শৃঙ্খল যে কোনও কোম্পানির মনে রয়ে যাবে।
যাই হোক না কেন, ট্রাম্প এখনও চীনের সাথে একটি প্রকাশ্য অচলাবস্থায় রয়েছেন। এখান থেকে পিছু হটা কঠিন হতে পারে। আমরা যখন এই তালিকা প্রকাশ করেছি, তখন চীনা আমদানির উপর আমেরিকার নতুন শুল্ক শতকরা ১২৫ ভাগে পৌঁছেছে। প্রতিশোধের জন্য চীনের শুল্ক শতকরা ৮৪ ভাগে পৌঁছেছে।
এই শুল্ক বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে পণ্য বাণিজ্যকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। এমনকি পরাশক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
ট্রাম্প বলছেন যে- চীন একটি চুক্তি করতে চায়। কিন্তু, আমেরিকার মিত্রদের মতো, কেবল তিনিই জানেন যে এই চুক্তি কী হতে পারে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের বাণিজ্য পদ্ধতির বিরুদ্ধে পশ্চিমা অভিযোগের শেষ নেই। দেশটি দীর্ঘদিন ধরে অন্তত ডব্লিউটিও’র চেতনা লঙ্ঘন করে আসছে। চীনের উৎপাদন উদ্বৃত্ত এত বেশি হওয়ার বড় কারণ এর নিজস্ব উৎপাদন খরচ খুব কম।
সুপারপাওয়ার শোডাউন
তবুও, একটি ধ্বংসাত্মক এবং অপ্রত্যাশিত শুল্ক যুদ্ধ কখনই এই সমস্যাগুলো সমাধানের সঠিক উপায় ছিল না। উভয় পক্ষের শুল্ক গভীর অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে। এটি সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকিও বাড়াতে পারে। আমেরিকার জন্য আরও আশাব্যঞ্জক পথ ছিল তার মিত্রদের একটি মুক্ত-বাণিজ্য ব্লকে একত্রিত করা- যাতে চীনকে তার বাণিজ্য অনুশীলন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা যায়। ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের পিছনে এই কৌশলটিই ছিল, একটি বাণিজ্য চুক্তি যা ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে বাতিল করেছিলেন। ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট মিত্রদের সাথে একটি বাণিজ্য চুক্তি করার এবং ‘একটি গোষ্ঠী হিসাবে’ চীনের সাথে যোগাযোগ করার কথা বলছেন। কিন্তু এখন যেহেতু এটি তার মিত্রদের হুমকি দিয়েছে এবং তার অতীতের চুক্তিগুলো থেকে সরে এসেছে, আমেরিকা দেখতে পাবে যে তারা সহযোগিতা করতে কম ইচ্ছুক।
ট্রাম্পের বেপরোয়া এজেন্ডার অদূরদর্শিতাই এই। মাত্র দশ দিনের মধ্যে তিনি বিশ্ব অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপনকারী পুরনো নিশ্চায়কগুলো ভেঙে ফেলেছেন। এর পরিবর্তে অসাধারণ মাত্রার অস্থিরতা এবং বিভ্রান্তি এসেছে। আপাতত কিছুটা বিশৃঙ্খলা হয়তো কমেছে। কিন্তু যা হারিয়ে গেছে তা পুনর্র্নিমাণ করতে অনেক সময় লাগবে।