অনলাইন
হামলার পর আশা ও ভয় নিয়ে পেহেলগামে ফিরছেন পর্যটকরা
মানবজমিন ডিজিটাল
(৮ ঘন্টা আগে) ২৯ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ৫:০৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৭ পূর্বাহ্ন
ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে একটি পাহাড়ি রিসর্টের কাছে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার এক সপ্তাহ পরও, শহরটি নীরব জনশূন্য। যদিও পর্যটকরা অল্প সংখ্যায় ফিরতে শুরু করেছেন। গত সপ্তাহে পর্যটকদের সরিয়ে দেবার পর হোটেলগুলো সম্পূর্ণ খালি করে দেয়া হয়। দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়। সেখানে আবার জীবনের ক্ষণস্থায়ী লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে সন্ত্রাসীরা যাদের উপর গুলি চালায়, তাদের বেশিরভাগই পর্যটক ছিলেন। তারা পেহেলগাম থেকে তিন মাইল (৫ কিলোমিটার) দূরে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত বৈসারণ পরিদর্শন করছিলেন। বৈসারণকে ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আক্রমণটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক, যা অনেক পরিবারের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ভারতবাসীর মনে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এরপর থেকে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দিল্লি থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া আসবে কিনা তা নিয়ে এখন জল্পনা চলছে। কাশ্মীর সরকার উপত্যকার অর্ধেকেরও বেশি পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে এবং তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। যদিও এই অঞ্চলে সহিংসতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। ১৯৮৯ সালে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে সন্ত্রাসীরা নিরাপত্তা বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে আসছে। তবুও পর্যটকদের নির্লজ্জ হত্যার ঘটনা বিরল। এই হামলা স্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং পর্যটক উভয়কেই হতবাক করেছে।
পেহেলগামের মতো জায়গায় পর্যটন অর্থনীতির মূল ভিত্তি এবং এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে যে অনেকের জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শহরের বাইরে একটি ‘সেলফি পয়েন্টে’ দাঁড়িয়ে মুম্বাইয়ের একজন পর্যটক অক্ষয় সোলাঙ্কি বলছেন, হামলার দিন তাদের মতো অনেক ভ্রমণকারীদের মধ্যে ‘আতঙ্ক’ ছিল। কিন্তু তারা তাদের যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কারণ বাড়ি ফেরার বিমানের ভাড়া সেইসময় অত্যধিক ব্যয়বহুল ছিল। অন্যান্য পর্যটকরা বলেছেন যে, স্থানীয় বাসিন্দা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে ক্রমাগত আশ্বাস তাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। রাজধানী শ্রীনগর থেকে পর্যটকদের নিয়ে আসা একজন চালক বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন যে, তিনি ভ্রমণকারীদের কাশ্মীর থেকে দূরে না থাকার অনুরোধ করেছেন। ঘটনার তিন দিন পর শাল বিক্রেতা রাফি আহমেদ জানাচ্ছেন যে, তিনি মাত্র কয়েকটি শাল বিক্রি করতে পেরেছেন এবং পর্যটকদের আসা বন্ধ হয়ে গেলে তার জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পর্যটকদের পেহেলগামে আসার জন্য উৎসাহিত করার মধ্যে ছিলেন বলিউড অভিনেতা অতুল কুলকার্নি যিনি হামলার কয়েকদিন পর শহরটি পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি বিবিসি হিন্দিকে বলেন, ‘যদি সন্ত্রাসীদের বার্তা হয় এখানে এসো না, তাহলে আমাদের আরও বেশি সংখ্যায় এসে সাড়া দেওয়া উচিত। আমি বলবো বুকিং বাতিল করবেন না। বরং অন্যান্য পরিকল্পনা বাতিল করে আপনারা কাশ্মীরে আসুন।’
কিন্তু পেহেলগামে অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা বিরাজ করছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে পেতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা বিবিসিকে একথা জানিয়েছেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে, শত শত লোককে আটক করেছে এবং সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত জুড়ে গুলি বিনিময়ের খবরও পাওয়া গেছে। উত্তেজনা বৃদ্ধির ফলে পর্যটক এবং ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়শই দাবি করে আসছে যে, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা বাতিল করার পর থেকে সেখানে তুলনামূলকভাবে শান্তি বিরাজ করছে। ২০২৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনের আগে, মোদি বলেছিলেন কাশ্মীর উন্নয়নের নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, কারণ এখানকার মানুষ স্বাধীনভাবে শ্বাস নিচ্ছে। বিজেপির শীর্ষ নেতারা উচ্চ পর্যটন সংখ্যার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন, গত বছর প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ এবং তার আগের বছরগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাশ্মীরে এসেছিলেন। বছরের পর বছর অস্থিরতার পরে এটি পর্যটন সংখ্যা বৃদ্ধির বড় প্রমাণ। কিন্তু গত সপ্তাহের হামলা আবারও অশান্ত উপত্যকায় স্থায়ী শান্তির ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে।
পেহেলগামের একজন রাজনীতিবিদ রাফি আহমেদ মীর বিবিসি হিন্দিকে বলেন, ‘এই (আক্রমণ) আমাদের কাছে কলঙ্কের মতো... আমরা কীভাবে এটি মুছে ফেলব তা উদ্বেগের বিষয়। তিনি বার বার একটি কথাই বোঝাতে চেয়েছেন, হামলার পর স্থানীয় কাশ্মীরিরা সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছিল, এমনকি তারা মৃতদেহও বহন করে নিয়ে গিয়েছিলো। মুম্বাই-ভিত্তিক ট্যুর অপারেটর অভিষেক সানসারে বিবিসিকে বলেন, পুনে, মুম্বাই এবং বেঙ্গালুরুর মতো শহর থেকে কাশ্মীরে পরিকল্পিত ভ্রমণ বাতিলের হার অনেক বেশি। বিশিষ্ট ট্যুর অপারেটরদের একটি দল এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে যে সমস্ত বুকিংয়ের প্রায় ৮০-৯০% বাতিল করা হয়েছে। অভিষেক সানসারে বলছেন, এই হামলার পর, একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে। তাই পর্যটকরা কী করবেন তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। যারা ইতিমধ্যেই অগ্রিম বুকিং করে রেখেছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমিও আগামী মাসের ২ তারিখে পেহেলগামে যাচ্ছি।
পর্যটকদের উপর এই হামলার ফলে গোটা কাশ্মীরের উপরও প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাশ্মীর উপত্যকাকে ভারতের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করার জন্য নির্মিত বিশ্বের সর্বোচ্চ একক-খিলান রেল সেতুর উদ্বোধন বেশ কয়েকবার বিলম্বের পর এই মাসেই হওয়ার কথা ছিল। এই প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় এখন অনিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে। একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে। এই অঞ্চলে নতুন ব্যবসায়িক বিনিয়োগ আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি না পাল্টালে তবে সেগুলিও হাতের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় বৃহত্তম হিমাগারের মালিক উবায়ের শাহ বলছেন, যারা লজিস্টিক এবং অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করছিলেন তারা এখন নিরাপত্তার পরিবেশের কারণে দুবার ভাববেন। যতক্ষণ না তারা কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পান, ততক্ষণ আমি কাশ্মীরে অবিলম্বে বিনিয়োগ আসবে বলে মনে করি না।'
সোমবার জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভায় এক আবেগঘন বক্তৃতায়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং পর্যটনমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ২৬ জনের নাম স্মরণ করে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে মানুষ আক্রমণের শিকার হয়েছে। যদিও পর্যটকরা তার আমন্ত্রণে কাশ্মীরে এসেছিলেন কিন্তু তিনি তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে পারেননি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো কোনও ভাষা আমার কাছে ছিল না। যেসব শিশু তাদের বাবাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেছে, তাদের কাছে আমি কী বলব? নৌবাহিনীর ওই অফিসারের বিধবা স্ত্রীকে, যার মাত্র কয়েকদিন আগে বিয়ে হয়েছে? কিছু লোক আমাকে বলেছিল যে তারা প্রথমবারের মতো কাশ্মীরে এসেছে, কিন্তু ছুটিতে এসে তাদের জীবনের অনেক বড় মূল্য দিতে হলো। এই হামলা কাশ্মীরকে ‘ফাঁকা’ করে দিয়েছে।'
সূত্র : বিবিসি
পাঠকের মতামত
কোন ভয় নেই। ওইটা মোদির স্টান্টবাজি ছিল।