শেষের পাতা
প্রস্তাবিত বাজেট হতাশার বাজেটে রূপান্তর হয়েছে
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১৯ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অনেক প্রত্যাশা ছিল। তা বাস্তবায়ন দেখতে পাইনি। প্রস্তাবিত বাজেট হতাশার বাজেটে রূপান্তর হয়েছে। এ সরকার সাধারণ সরকার নয়। কিন্তু বাজেটে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা গতানুগতিক। এই বাজেট সংস্কারবিমুখ ও সাম্যবিরোধী।
বুধবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে নাগরিক প্ল্যাটফরম আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬: অবহেলিতরা কী পেয়েছে’ শীর্ষক বহুপক্ষীয় অংশীজন সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যে প্রত্যাশা থেকে ৫ই আগস্ট হয়েছিল এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে প্রয়োজন সামনে এসেছিল, বাজেটে তা প্রতিফলিত হয়নি, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর যে দাবি ছিল তা প্রতিফলিত হয়নি। এ বাজেটে ভুল-ভ্রান্তি আছে। এ বাজেট সংস্কারবিমুখ। বাজেটের ভেতর দিয়ে সংস্কারের ধারণা চেতনা আমরা সামনে এনেছিলাম। এ সরকার নিজে আমাদের দিয়ে যেই কাজগুলো করিয়েছিল সেগুলোর প্রতি তারা বিশ্বস্ত থাকেনি। এ বাজেট সাম্যবিরোধী হয়েছে। তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত একটা বড় প্রত্যাশার বাজেট ছিল। একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে সরকার এসেছে। বৈষম্যবিরোধী চেতনার ভেতর দিয়ে সরকার গঠন করা হয়েছে। এটা গতানুগতিক বাজেট থেকে ভিন্ন কিছু ছিল এরকম বড় প্রত্যাশা ছিল। এর বিপরীতে বলা যায় এটা অনেক ক্ষেত্রেই হতাশার বাজেটে পরিণত হয়েছে। প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গে হতাশা এসেছে। কারণ আমাদের আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন ছিল, আমরা দেখেছি অনেক ক্ষেত্রেই বাজেট গতানুগতিক হয়েছে।
গত ২রা জুন নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
দেবপ্রিয় মনে করেন, টেলিভিশনে সম্প্রচার না করে বাজেট ‘জনসম্মুখেও’ হতে পারতো। মন্ত্রিপরিষদে পাস না করিয়েই বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা আমার চোখে লেগেছে যে, মন্ত্রিসভায় পাস করার আগে এটা উপস্থাপন করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় পাস হয়ে সাধারণত এটা আসে।
সংলাপে সিপিডি’র বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাকে সংকুচিত করা হয়েছে। এর ফলে প্রস্তাবিত বাজেট একদিকে সংশ্লিষ্ট বছরের জন্য বাজেটকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, পাশাপাশি আগামী বছরের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, বয়স্ক ভাতা ৬০০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করেছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি ৬০০ টাকা থেকে বেড়ে ৯০০ টাকা হয়েছে। এতে বাজেটে প্রকৃত অর্থেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কমেছে। এর ফলে পরবর্তী যে সরকার আসবে এবং বাজেট প্রণয়ন করবে সে সরকারের কাছে থেকে আদায় করতে ন্যায্যতা হারাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অস্থায়ী একটা সরকার। এর কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু যেহেতু গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার এসেছে সেজন্য কিছু পরিবর্তনের সূচনা এ সরকারের মাধ্যমে হবে, এটাই প্রত্যাশা ছিল। সেটার একটা প্রতিফলন আমরা বাজেটে আশা করেছিলাম।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটকে সুযোগ হারানোর (মিস অপরচুনিটিস) বাজেট বলা যায়। বাজেটে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বেশ বড় একটা ফারাক দেখতে পাচ্ছি। মূল সমস্যাটা হলো, পুরনো বাজেটের কাঠামোর মধ্যেই নতুন কিছু দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বাজেটে যে লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। তিনি বলেন, শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও রয়েছে। কিন্তু বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন নেই। সামাজিক সুরক্ষা খাতে কিছু পুনর্গঠন হয়েছে, কিন্তু খুব বড় ধরনের কোনো পুনর্গঠন দেখা যায়নি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের যে বরাদ্দ হয়েছে, এটাও অনেক কম। অথচ বাজেটে এবার একটা ভিন্ন কিছু করার সুযোগ ছিল।
হিসাববিদ জিয়া হাসান বলেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমে গেছে। মূল্যস্ফীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভোক্তা চাহিদায়। অথচ বাজেট প্রস্তাবে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হয়নি।
আইসিএমএবি’র সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেট একেবারে শেষ হয়ে গেছে। সরকার বাজেটে ক্যাপিটাল মার্কেটের জন্য কিছু করেনি।
তৃতীয় লিঙ্গের সঞ্জিবনী সুধা বলেন, বাজেটে বরাদ্দ থাকে কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। ফলে তৃতীয় লিঙ্গের জীবন মানের উন্নতি হয় না, কর্মসংস্থান হয় না। ফলে আয় নেই। তাই জীবন ধারণের জন্য পথে পথে মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। বাজেটে এই শ্রেণির মানুষের জন্য আগেও থাকতো না, এবারও তাই হয়েছে।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, বাজেটে যে আলোচনা হওয়া দরকার ছিল সেটা হয়নি। ফলে বাজেট ইনক্লুসিব হয়নি বলে আমরা মনে করি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন বলেন, প্রতি বছর দেশি-বিদেশি ঋণ বাড়ছে। এক্ষেত্রে জাকাতকে আয়ের উৎস করা যেতে পারে। একটি জরিপ অনুযায়ী প্রতি বছর দেশে ১ লাখ কোটি টাকা জাকাত আদায় সম্ভব বলে জানান তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র জয়েন্ট কনভেনর সামান্তা শারমিন বলেন, বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কারণ তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) কেয়াটেকার সরকারের মতো আচরণ করেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন- সিপিডি’র সিনিয়র গবেষণা ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বাজেট বিশ্লেষণে দেখান, অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেট বরাদ্দ যথেষ্ট নয় এবং এর বাস্তবায়ন নিয়েও রয়েছে গভীর প্রশ্ন।
অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ, গবেষক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অংশগ্রহণকারীরা বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং ন্যায্যতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের আহ্বান জানান।