ঢাকা, ১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৪ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

প্রথম পাতা

সুইস ব্যাংকে কারা টাকা সরিয়েছেন

এম এম মাসুদ
২১ জুন ২০২৫, শনিবার
mzamin

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে বলে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল  ব্যাংকের (এসএনবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৩ গুণ বেশি। এসএনবি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্র্যাংক বা প্রায় ৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

গত দুই বছর টানা পতনের পর গত বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ আকস্মিক বৃদ্ধির সময়কালে পতিত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। দেশে একটি অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি পার করেছে। তাই বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত ব্যক্তিরা বিদেশে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। ফলে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের এই উল্লম্ফন ঘটেছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বা কালো টাকাই বেশি পাচার হয়। দুর্নীতি বাড়ায় এসব অর্থই সুইস ব্যাংকে আমানত বৃদ্ধির একটি প্রধান চালিকা শক্তি হতে পারে। এ ছাড়া, দেশের টাকা পাচারের উল্লেখ্য কারণ হলো- দুর্নীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা, হুন্ডি ও অবৈধ লেনদেন, আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কারসাজি, বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, গোপনীয়তার নীতি ও আন্তর্জাতিক তথ্য বিনিময় চুক্তিতে বাংলাদেশের অনুপস্থিতি। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

উল্লেখ্য, সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে গ্রাহকের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করে না, শুধু দেশভিত্তিক আমানতের পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে। তাই ঠিক কোন ধরনের অর্থ সেখানে জমা হচ্ছে, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না।
গত বছরের (২০২৪) ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। বিগত সরকারের সময়ের সুবিধাভোগীদের একটি বড় অংশ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠদের অর্থসম্পদ বাজেয়াপ্ত হতে শুরু হয়েছে। তাই অনেকেই বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তর করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত বছরের বেশির ভাগ সময় দেশে রাজনৈতিকভাবে অস্থির সময় গেছে। ফলে যাদের কাছে টাকা ছিল এবং যারা দেশে টাকা রাখাটা নিরাপদ মনে করেন না তারা সুইস ব্যাংকগুলোয় অর্থ স্থানান্তর করতে পারেন। যে কারণে আগের তুলনায় গত বছর জমা করা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। তিনি বলেন, অনেকে বৈধ ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায়ও সেখানে অর্থ পাঠাতে পারেন। আবার নিরাপদ ব্যাংকিং সিস্টেমের কারণে বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরাও তাদের বৈধ অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় জমা রাখতে পারেন। তাই সুইস ব্যাংকগুলোয় জমা থাকা অর্থের কতো শতাংশ অবৈধভাবে উপার্জিত, সেটি সঠিকভাবে বলার সুযোগ নেই। তবে, ধারণা করা হয় এর সিংহভাগ অর্থ অবৈধ। অর্থ পাচার জানার সুযোগ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড নামে একটি সিস্টেম রয়েছে, যেটাতে বাংলাদেশ এখনো অংশগ্রহণ করেনি। এই সিস্টেমে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সুপারিশ ছিল। এই সিস্টেমে অংশগ্রহণ করা হলে এ অর্থ বৈধ নাকি অবৈধ, কী প্রক্রিয়ায় এ অর্থ গেছে, কার অর্থ, কোন ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ অর্থ গেছে- সেসব তথ্য আমাদের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ জানতে পারতো। এ সুযোগটা বাংলাদেশ এখনো নেয়নি। বিশ্বের ১২২টি দেশ এ সুযোগ নিয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের সময়ে এ সুযোগ গ্রহণের উদ্যোগ দেখা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এটি গ্রহণের সুযোগ ছিল। এসব তথ্য জানা থাকলে দেশ থেকে এ অর্থ পাচার ঠেকানোর জন্য উদ্যোগ নেয়া সহজ হতো।

সুইস ব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যান সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমেও অর্থ পাচার এবং মানি লন্ডারিং হয়ে থাকে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে আগস্টে সরকারের পতন হয়েছে। ধারণা করা যায়, ওই বছর অর্থ পাচার বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত পরিসংখ্যানগুলো যাচাই করে এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করা। তার মতে, বাণিজ্যিকভাবে যদি পাচার না হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই এটি ‘ক্যাপিটাল ফ্লাইট’ (পাচার)। শুনেছি, জাস্ট টিউশন ফিস দেয়ার মাধ্যমে বিদেশে ৬০০-৭০০ কোটি টাকা ট্রান্সফার হয়েছে। অর্থাৎ নিয়মের মধ্যে থেকেও অনিয়ম কাজ করা যায়। সরাসরি বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। রেগুলেটরের অনুমোদন ছাড়া এটা গেছে বলে মনে হয় না। তখনকার রেগুলেটররাই এসব করতো। সরিষার মধ্যে ভূত। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগের সরকারগুলো এ বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছে। কিন্তু কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত অবিলম্বে চুক্তিতে যোগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা। এই সুযোগ এখন হাতছাড়া হলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়াটা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। 

দেশের শীর্ষ ব্যাংকারদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নতুন চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাসরুর আরেফিন বলেন, মাত্র এক বছরে ৮ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে ডিপোজিট বাড়ার ব্যাপারটা একটা অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব ঘটনার মতো। নিঃসন্দেহে আগের সরকারের পতনের আগে-পরে বিশ্বাস, আস্থা ও ভয়ের জায়গা থেকে এটা করেছে ধনিক শ্রেণির সেই অংশ, যারা মূলত দুর্বৃত্ত। এগুলো হলো- বাংলাদেশের অনেকটা ব্যাংক খালি করে দেয়া ঋণের টাকা, ট্রেড ব্যবসার ওভার ইনভয়েসিং থেকে নিয়ে যাওয়া টাকা, শেয়ারবাজারে গেম খেলে হাতানো টাকা। এ ছাড়া, শেষে খেটে খাওয়া মানুষের অর্থাৎ সাধারণ আমানতকারীদের ও বিনিয়োগকারীদের টাকা পাচার করা হয়েছে। 
প্রসঙ্গত, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটি বাণিজ্যের আড়ালে কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার প্রাক্কলন করে। জিএফআইয়ের প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে গড়ে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। 
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্র্যাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে যা ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০২২ সালে ছিল ৫ কোটি ৫৩ লাখ ফ্র্যাংক। তবে, এর আগে ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্র্যাংক। এটি এ যাবত কালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এ ছাড়া, ২০২০ সালে যা ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। ২০১৯ সালে ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৮ সালে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি ৮ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক।

পাঠকের মতামত

এই ঊল্লম্ফন হয়েছে গত এক বছরে। ঢালাও কাউকে দোষারোপ না করে সঠিক তদন্ত করা উচিৎ। তা- না হলে প্রকৃত দোষীরা আরও উতসাহ পাবে।

Mohsin
২১ জুন ২০২৫, শনিবার, ১১:১৩ অপরাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status