প্রথম পাতা
জুলাই দাঙ্গা
ইতিহাস রাজকুমারের গল্প নয়
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
১০ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার
প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা কেবল ক্ষমতার রূপান্তর নয়-বরং ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা পুনঃনির্ধারণ করে এবং নৈতিক, আত্মিক ও ইতিহাসবোধের এক গভীর-নির্ধারক সংজ্ঞা বহন করে। তেমনি ’২৪-এর জুলাই ‘গণ-অভ্যুত্থান’ ছিল জনগণের লড়াই-সংগ্রাম ও বীরত্ব প্রদর্শনের ঐতিহাসিক পর্ব। এই বিদ্রোহ ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক চেতনার মহৎ বিস্ফোরণ। অসংখ্য ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগকে ক্ষমতাচ্যুত পরিবারের উত্তরাধিকারী সজীব ওয়াজেদ জয় ‘দাঙ্গা’ বলে অভিহিত করেন। এই কথার মধ্যদিয়ে তিনি সত্যের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থানকে ‘দাঙ্গা’ বলা ইতিহাসের সঙ্গে এক নিষ্ঠুর রসিকতা। সত্যকে অস্বীকার করা-কখনো বিবেকের কণ্ঠ হতে পারে না।
একটু অতীতে ফিরে তাকাই। ১৯৭১ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি শাসকগণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে ‘দাঙ্গা’ সৃষ্টিকারী এবং ‘কালো অধ্যায়’ হিসেবে চিহ্নিত করতো। কারণ, তারা জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে অপরাধ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিল। আজ সেই একই বয়ানে, জয় সাহেব জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে ‘দাঙ্গা’ ও ‘কালো অধ্যায়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সময় বদলায়, চেহারা বদলায় কিন্তু জনগণকে অভিযুক্ত করার ভাষা বদলায় না। শাসকদের অভিধানে জনগণ সব সময় অপরাধীই থাকে। আওয়ামী লীগের অভিধানে ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান কখনোই ‘গণ-জাগরণ’ বা ‘গণ-বিপ্লব’ নামে পবিত্রতা পাবে না। কারণ, তারা জনগণের নয়, ক্ষমতার ইতিহাস লিখতে চায়।
ইতিহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যারা প্রোপাগান্ডার পক্ষে কথা বলে, তারা কেবল সত্যকে আড়াল করে না, অন্যায়ের পুনরাবৃত্তিকে বৈধতা দেয়। মানুষের ন্যায়সঙ্গত বিদ্রোহকে ষড়যন্ত্র বলা- ইতিহাসের পুরনো রোগ। যে-তরুণেরা প্রাণ দিয়েছে, ন্যায়ের জন্য রক্ত দিয়েছে-তাদের আত্মত্যাগকে ‘ভুল’ বলে অবমূল্যায়ন করা মানেই রক্তের ঋণ অস্বীকার করা। শাসক ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে এই ভাষা নতুন কিছু নয়। স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত, ইতিহাস জুড়ে শাসকগোষ্ঠী বারবার জনগণের সংগ্রামকে ষড়যন্ত্র, নাশকতা কিংবা ‘দাঙ্গা’ বলে চিহ্নিত করেছে। কারণ, সত্যের মুখোমুখি হওয়ার নৈতিক সাহস তাদের নেই। তারা চায় শাসকের বয়ান টিকে থাকুক; শহীদদের রক্ত নয়। কিন্তু ইতিহাস জানে, যারা সত্যের পক্ষে আত্মত্যাগ করে-তারাই শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের মালিক হয়। আর যারা রক্তের ঋণ অস্বীকার করে, তারা ইতিহাসের কাছে করুণাযোগ্য হয়ে ওঠে।
প্রতিটি শহীদের রক্ত, প্রতিটি মিছিলে পুড়ে যাওয়া মুখ, পুলিশি বুলেটের শিকার হওয়া সেই তরুণেরা ভুল বোঝেনি। তারা বুঝেছিল-এই রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র নয়, এটি এক দখলদার গোষ্ঠীর বলপ্রয়োগের কারখানা। তারা সাহস দেখিয়েছিল, আর সেই সাহসকে আজ ‘ভুল’ বলে উপহাস করা হচ্ছে। উপনিবেশিক অস্তিত্বের দার্শনিক ফ্রান্ৎজ ফানোঁ বলেছিলেন: ‘Each generation must, out of relative obscurity, discover its mission, fulfill it, or betray it.’ অর্থাৎ,
‘প্রতিটি প্রজন্মকে ইতিহাসের অনির্দিষ্টতার আঁধার থেকে নিজেদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব আবিষ্কার করতেই হবে- সেই দায়িত্ব পূরণ করতে হবে, নতুবা তা বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত হবে।’
গণ-অভ্যুত্থানকারীরা ইতিহাসের কাছে ঋণী ছিল না, বরং ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রজন্ম জানতো, স্বাধীনতা শুধু অতীতের গর্ব নয়, বর্তমানের সংগ্রাম ও ভবিষ্যতের দায়িত্বও। তারা পিছু হটেনি, তারা বিবেক হয়ে উঠেছিল এবং বিবেক কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। কোনো প্রজন্মই পূর্বনির্ধারিত মহত্ত্ব নিয়ে জন্মায় না। তারা নির্দিষ্ট কোনো আলোতে নয়, বরং অস্পষ্টতা, সংকট ও দ্বিধার ভেতর দিয়েই নিজেদের কর্তব্য বুঝে নিতে বাধ্য হয়। প্রতিটি প্রজন্মকে নিজস্ব বাস্তবতা ও সংকট থেকে তাদের ‘ঐতিহাসিক মিশন’ নির্ধারণ করতে হয়। যেমন ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান। সুতরাং, গণ-অভ্যুত্থানে জড়িত বর্তমান প্রজন্ম-ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিজেরাই নিজেদের ‘ঐতিহাসিক মিশন’ নির্ধারণ করে নিয়েছে। আত্মদান ও বীরত্ব প্রদর্শন করে ইতিহাসের নির্ধারিত ন্যায়ের পথে অগ্রসর হয়েছে।
‘ভুল’ নয়, ন্যায়বোধই জনগণকে রাস্তায় নামিয়েছিল। কারণ, জুলাই হঠকারী কোনো দাঙ্গা নয়-তা ছিল প্রজাতন্ত্রের আত্মগঠনের এক মৌলিক মুহূর্ত, যেখানে জনগণ তাদের আত্মমর্যাদা, মানবিক অধিকার ও সাংবিধানিক স্বপ্ন পুনরুদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। জয় সাহেব অনুধাবন করতে পারেন নি-জুলাই ছিল এই জাতির আত্মপরিচয় পুনর্গঠনের মুহূর্ত এবং তা ছিল আত্মদর্শনের নবায়ন। যেখানে রক্ত ঝরেছে, মনুষ্যত্ব বিক্রি হয়নি।
আমরা যারা রাষ্ট্র সুরক্ষার প্রয়োজনে রাস্তায় নেমেছিলাম, মিছিলে হাঁটতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলাম, জীবন বাজি রেখে ফ্যাসিবাদের পতন অনিবার্য করে তুলেছিলাম-কেউই তা ‘ভুল’ বুঝে করিনি। কারণ, আমরা জানতাম-এই রাষ্ট্র আমাদের নয়, এটি কোনো পরিবারের হাতে বন্দি এক ব্যক্তিগত রাষ্ট্র। আমরা স্ব-জ্ঞানে, স্বেচ্ছায় জনগণের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, ইতিহাসের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। আলবেয়ার কামু বলেছেন-“I rebel&Ztherefore we exist.” জনগণের বিদ্রোহ তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ। এই গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের আত্মঘোষণা ছিল-আমরা আছি এবং আমরা অন্যায় মেনে নেবো না।
‘দাঙ্গা’ শব্দটি এখানে নির্বাচিত হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিরোধকে অপরাধে পরিণত করতে। এটি ফ্যাসিবাদের পুরনো কৌশল। উমবের্তো একো এই অবস্থাকে বলেন-‘‘Ur-Fascism speaks Newspeak.”
যেখানে প্রতিবাদ মানে ‘ষড়যন্ত্র’, সংগ্রাম মানে ‘উগ্রতা’ এবং রাষ্ট্র মানে ‘পারিবারিক সম্পত্তি’। এই হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ভাষার বুনট। ফ্যাসিবাদ ভাষাকে একটি বন্দিশালায় পরিণত করে। যেখানে শব্দ জীবিত থাকে না, প্রশ্ন নিষিদ্ধ হয়, আর সত্য কেবলমাত্র ক্ষমতার মুখপাত্রে পরিণত হয়। এই ভাষা মুক্তচিন্তার শ্বাসরোধ করে, বুদ্ধিবৃত্তিকে অপবিত্র ঘোষণা করে এবং নৈতিক জিজ্ঞাসাকে রাষ্ট্রদ্রোহে পরিণত করে।
হাজার হাজার তাজা প্রাণ চিরতরে স্তব্ধ হলো, রাজপথ রঞ্জিত হলো, চিরকালের জন্য চোখ হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের জন্য-ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কোনো দুঃখ হয় না। এমনকি সাঁজোয়া যান থেকে গুলিবিদ্ধ আহত ইয়ামিনকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার বর্বরতার মতো রাষ্ট্রের অজস্র পাপ-তাদেরকে স্পর্শ করে না। ভয়াবহ গণহত্যার কোনো দায়-দায়িত্বের স্বীকারোক্তি না দিয়ে ফ্যাসিবাদীরা প্রমাণ করেছে-তারা ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রীয় অপরাধে একাত্ম।
ফরাসি দার্শনিক পল রিকার বলেন-
“To be forgotten is to die twice.”
যারা শহীদদের আত্মত্যাগকে ‘ভুল’ বা ‘ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করছে, তারা শহীদদেরকে দ্বিতীয়বার হত্যা করছে। ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করছে-একটি নৈতিক মুক্তির সম্ভাবনাকে।
যেখানে আহতদের ফেলে দেয়া হয়, লাশ পুড়িয়ে মারা হয়-সেখানে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় হান্না আরেন্টের বিখ্যাত ধারণা-‘‘Evil is not always monstrous&Zit is often routine, bureaucratic, thoughtless.’ এই ‘Thoughtless cruelt’ হলো-সবচেয়ে বিপজ্জনক নিষ্ঠুরতা। কারণ, এটি পরিকল্পিত দানবীয়তার চেয়েও বেশি বিস্তার লাভ করে। যারা চিন্তা না করে ক্ষতি করে, তারা নিজের দায়বদ্ধতা বোঝে না, ক্ষমা চায় না, অনুশোচনাও করে না। যারা এসব ঘটনার খলনায়ক বা সমর্থক, তারা মানুষ হিসেবে নৈতিকভাবে দেউলিয়া।
যারা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী মনে করে মানুষ খুন করেছে, ন্যূনতম অনুতাপ না করে আবারো তারা দ্বিতীয়বার খুন করছে। নিজেদের কৃতকর্মের ক্ষমা না চেয়ে, গণ-অভ্যুত্থানের জনতাকে অপরাধী বানিয়ে ক্ষমার ভান করা ভয়াবহ অন্যায়। ইমানুয়েল কান্ট এর মতে-‘‘মানুষকে কখনোই একটি মাধ্যম (Means) হিসেবে নয়, বরং সর্বদা একটি উদ্দেশ্য (End) হিসেবে দেখতে হবে।
মানুষ স্বয়ং এমন এক সত্তা, যার ভেতরে নিজস্ব মূল্য ও মর্যাদা নিহিত। কোনো বাহ্যিক লাভ বা ফলাফলের জন্য তাকে ব্যবহার করা অনৈতিক।” ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ-মানুষকে কখনোই উদ্দেশ্য (End) হিসেবে দেখেনি, কেবল ক্ষমতা রক্ষার যন্ত্র (Instrument) হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা ভুলে যায়-ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু রক্তাক্ত ইতিহাস চিরস্মরণীয়।
ইতিহাস কোনো রাজকুমারের ফ্যান্টাসি নয়। এটি তাজা রক্তে লেখা জনতার দ্রোহের দলিল- যেখানে মায়ের আহাজারি একমাত্র সাক্ষী।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠকের মতামত
ধন্যবাদ ফরায়েজী সাহেবকে বাস্তব কথাগুলো তুলে ধরার জন্য। এগুলা জনগণের মনের কথা। জালিম স্বৈরাচারীরা এমন ই হয়। তাদের অন্তর মোহর মারা। তাই তারা অনুতাপ, অনুশোচনা করে না।
Excellent writing
ইতিহাসের বড় নির্মম সত্য হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। জাতির অভিভাবক হিসেবে নির্মোহ বিশ্লেষণ করার জন্য ধন্যবাদ।