শরীর ও মন
স্পোর্টস ইনজুরির প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
ডা. জি এম জাহাঙ্গীর হোসেন
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবারযেকোনো সময় খেলতে গিয়ে হাঁটুর ইনজুরিতে আক্রান্ত হতে পারেন। অনেক খেলোয়াড় স্পোর্টস ইনজুরিতে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ ভুগতে থাকেন। তবে কতোদিনে সেরে উঠবেন, কতোদিন ভুগতে পারেন বা সহজে ভালো হবেন বা হবেন না, তা নির্ভর করে আক্রান্তের ধরনের ওপর। যদি কেউ মারাত্মক ইনজুরিতে পড়েন তাহলে সেরে উঠতে বেশ সময় লেগে যায়। আবার অনেকে পঙ্গুত্ববরণও করেন। তবে বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে মারাত্মক ইনজুরি বা আক্রান্ত ব্যক্তিরাও সেরে উঠে আবার খেলায় ফিরে এসেছে, এরকম অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে শুধু সচেতনতার অভাবে ও খেলোয়াড়কে যথোপযুক্ত চিকিৎসা এবং পরিমিত পরিচর্যার অভাবে খেলোয়াড় জীবনের পরিসমাপ্তি টানতে হয়। সাধারণত শরীরের বড় ও ওজন বহনকারী জোড়াগুলোর মধ্যে অন্যতম বিধায় হাঁটু স্পোর্টস ইনজুরিতে আক্রান্ত হয় বেশি। হাঁটুতে চারটি প্রধান লিগামেন্ট ও দুইটি মিনিসকাস (তরুনাস্থি) থাকে। ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, ভলিবল, হ্যান্ডবল, কাবাডি ও হাডুডু খেলোয়াড়দের হাঁটুতে স্পোর্টস ইনজুরি হয়। এ ধরনের অধিকাংশ স্পোর্টস ইনজুরি মচকানো (টুইসটিং) প্রকৃতির। এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে অন্য খেলোয়াড়ের সংঘর্ষের ফলে হাঁটুতে স্পোর্টস ইনজুরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংঘর্ষ ছাড়াই (নন-কনট্র্যাক্ট) বিভিন্ন পরিস্থিতিতে হাঁটু ও পায়ের বিভিন্ন অবস্থানের জন্য লেগের হাড়ের (টিবিয়া) বাইরে বা ভেতরে ঘূর্ণায়ন হয় অথবা সামনে বা পেছনে সরে যায়। এ ধরনের আঘাতে হাঁটুর লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরি হয়ে থাকে। ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি খেলোয়াড়দের মধ্যে এনটেরিওর ক্রুসিয়েট ও মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট ইনজুরি বেশি হয়। ৭০ শতাংশ ব্যক্তির এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ইনজুরির সঙ্গে মেনিসকাস ইনজুরি থাকে। এ ছাড়াও জোড়া স্থানচ্যুতি এবং হাড় (টিবিয়াল স্পাইন) ফ্র্যাকচার হতে পারে।
স্পোর্টস ইনজুরিতে আক্রান্তের লক্ষণগুলো
১. আক্রান্ত ব্যক্তি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ‘পপ’ বা ‘ক্র্যাক’ শব্দ শুনতে বা বুঝতে পারবে। ২. প্রথমে তীব্র ব্যথা পরে আস্তে আস্তে ব্যথা কমে আসে। ব্যথা হাঁটুর বাইরের পার্শ্বে এবং পেছনে অনুভূত হবে। হাঁটু ভাঁজ বা সোজা করতে গেলে ব্যথা বেড়ে যায়। ৩. আঘাতের প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যে হাঁটু ফুলে যায়। প্রথমে না ফুললে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পরও হাঁটু ফুলতে পারে। ৪. পড়ে গেলে, দাঁড়াতে বা হাঁটতে চেষ্টা করলে মনে হবে হাঁটু ছুটে যাচ্ছে বা বেঁকে যাচ্ছে। ৫. ফুলা ও ব্যথার জন্য হাঁটু নড়াচড়া এবং সোজা করা যায় না। ৬. অনেক সময় হাঁটু আটকে যায়, বেশিক্ষণ বসলে রোগী হাঁটুকে নড়াচড়া করিয়ে সোজা করে। ৭. উঁচু-নিচু জায়গায় হাঁটা যায় না, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে এবং বসলে উঠতে কষ্ট হয়। ৮. হাঁটু অস্থিতিশীল বা ছুটে বা ঘুরে যাচ্ছে, এ রকম মনে হবে। ৯. দীর্ঘদিন ধরে লিগামেন্ট ইনজুরি থাকলে হাঁটুর পেশি শুকিয়ে যায় এবং হাঁটুতে শক্তি কমে যায়। ১০. সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে মাঝেমধ্যে হাঁটু ফুলে, হাড় ও তরুনাস্থি ক্ষয় হয় এবং অল্পবয়সে ওসটিও আর্থ্রাইটিস হয়।
প্রাথমিক অবস্থায় করণীয়
১. হাঁটুকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। ২. বরফের টুকরা টাওয়ালে বা ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি পলিথিন ব্যাগে নিয়ে লাগালে ব্যথা ও ফুলা কমে আসে। ৩. হাঁটুতে ইলাসটো কমপ্রেসন বা ব্রেচ ব্যবহারে ফুলা ও ব্যথা কমে আসে। ৪. হাঁটুর নিচে বালিশ দিয়ে হাঁটুকে হার্টের লেভেল থেকে উঁচুতে রাখলে ফুলা কম হবে। ৫. এনালজেসিক বা ব্যথানাশক ওষুধ সেবন। ৬. হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরির চিকিৎসা প্রদান করতে সক্ষম এমন চিকিৎসকের কাছে বা সেন্টারে রোগীকে পাঠাতে হবে।
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও প্রতিরোধ: প্রাথমিক চিকিৎসায় রোগীর ব্যথা ও ফুলা সেরে ওঠার পর, হাঁটুর বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে কী কী লিগামেন্ট ইনজুরি হয়েছে এবং এর তীব্রতা নির্ণয় করা যায়। কখনো কখনো এক্স-রে ও এমআরআইর সাহায্য নিতে হয়। হাঁটুর লিগামেন্ট বিস্তৃত (স্ট্রেস) ইনজুরি ও মেনিসকাসের ক্ষুদ্র ইনজুরি হলে প্রাথমিক চিকিৎসায় ভালো হয় এবং খেলোয়াড় খেলায় ফিরে যেতে পারে। তবে কিছু কিছু আংশিক টিয়ারের ক্ষেত্রে হাঁটুর পেশির ব্যায়াম ও দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে সুস্থ থাকা যায় এবং নিয়ন্ত্রিত খেলা খেলতে পারবে। লিগামেন্টের মধ্যে এনটেরিওর স্টুসিয়েট লিগামেন্ট তৈরি করা জরুরি কারণ এটা না করলে হাঁটু অস্থিতিশীল হবে এবং হাঁটুতে তাড়াতাড়ি ওসটিও আর্থ্রাইটিস হয়ে জোড়া নষ্ট হবে। বর্তমানে ছোট দুইটি ছিদ্র দিয়ে আর্থ্রোস্কোপ যন্ত্র হাঁটুতে প্রবেশ করিয়ে নতুন লিগামেন্ট তৈরি করা হয়। বড় ধরনের মেনিসকাস ইনজুরি হলে রিপেয়ার করা হয়। আর্থ্রোস্পোপিক সার্জারির পর নিয়মিত ও পরিমিত পরিচর্যার (রিহেবিলিটেশন) মাধ্যমে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে এবং খেলায় ফিরে যেতে পারবে। খেলায় ইনজুরির প্রবণতা ও তীব্রতা রোধে প্রয়োজন শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা এবং বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল। খেলা শুরুর আগে ও পরে শরীরের জোড়া ও পেশির নমনীয়, স্ট্রেসিং এবং শক্তিশালী হওয়ার ব্যায়াম করতে হবে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কৌশল লব্ধ করে স্পোর্টস ইনজুরি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়। ফলে খেলোয়াড় ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামগ্রিকভাবে দেশ লাভবান হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগ
হাড় ও জোড়া বিশেষজ্ঞ এবং আর্থ্রোস্কোপিক সার্জন
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), ঢাকা
চেম্বার: বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল লি., শ্যামলী মিরপুর রোড, ঢাকা-১২০৭
হটলাইন-১০৬৩৩, ০১৭৪৬৬০০৫৮২