ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

উদ্বেগ কাটেনি, সমাধানে জোর

এম এম মাসুদ
১২ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার
mzamin

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পর উদ্বিগ্ন ছিল সরকার ও রপ্তানিকারকরা। তবে পাল্টা শুল্ক বা রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিতের ঘোষণায় স্বস্তি ফিরেছে। যেসব দেশ সমঝোতার চেষ্টা করেছে তাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণার ঈঙ্গিত দিয়েছে ট্র্যাম্প প্রসাশন। পাশাপাশি ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের শেয়ারবাজার। অবশ্য বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য স্বস্তি ফিরলেও আতঙ্ক কাটেনি। কারণ এই তিন মাস ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বহাল থাকায় একধরনের অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে।

রপ্তানিকারক এবং বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কহার স্থায়ীভাবে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে তিন মাস সময়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানের বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ককে কীভাবে শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা যায়, তার কৌশল নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুল্ক-অশুল্ক বাধার অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এসব দূর করতে হবে। 

এদিকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ ৯০ দিনের বিরতি চেয়ে গত সোমবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে চিঠি দেন ড. ইউনূস। অন্যদিকে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ পণ্য আমদানিতে শুল্ক সুবিধা চেয়ে বাণিজ্য প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জেমিসন গ্রিয়ারকে আলাদা চিঠি দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। পরে ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের অনুরোধে সাড়া দেয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই বিরতি বাংলাদেশের প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময়। আপাতত তিন মাসের জন্য একটা স্বস্তি পাওয়া গেলেও ট্রাম্প প্রশাসন যাতে বাংলাদেশের ওপর আবার বাড়তি শুল্ক আরোপ না করে, সে জন্য সরকারকে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে। আবার চীন নতুন করে আরও বাড়তি শুল্কের মুখে পড়ায় আগামী ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারে।
পোশাক কারখানার মালিকরা জানান, আগামী ৯০ দিনের বিরতিতে তারা স্বস্তি পেয়েছেন। তবে উদ্বেগ থেকেই গেছে। কারণ ট্রাম্প ঘোষিত শুল্ক ৯০ দিন পর কার্যকর হলে বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক শিল্প সংকটে পড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিকারকদের ৫৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক গুনতে হবে। 

আশঙ্কা: চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বহাল থাকায় চীন ইউরোপে সস্তা কাপড়ে বাজার সয়লাব করে দিতে পারে। এটি বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য আরেকটি সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ যে ধরনের পণ্য বেশি রপ্তানি করে সেগুলোর গড় শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। এর সঙ্গে ১০ শতাংশ যোগ হয়ে আপাতত শুল্কহার ২৫ শতাংশ হবে। দেশভিত্তিক ৩৭ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যে মোট শুল্কহার ৫২ শতাংশে দাঁড়াতো। এরমধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ বাড়তি শুল্ক স্থগিত রাখার অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশ সময় চেয়েছে তিন মাস।

তৎপর ঢাকা: চীন ছাড়া নতুন আরোপ করা পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এই সময়ে দেশগুলোর পণ্যে পাল্টা শুল্ক ন্যূনতম ১০ শতাংশ কার্যকর হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক তিন মাস স্থগিত করায় পরবর্তী করণীয় নিয়ে তৎপর হয়েছে ঢাকা। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হবে। শুল্ক স্থগিত করায় আলোচনার সময় আরও পাচ্ছি। সাময়িক স্থগিতাদেশ দিয়েছে তাই নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাণিজ্যে ঘাটতি কমানোর নানা পদক্ষেপ নিতে পারবো।
শুল্ক স্থগিত করার অনুরোধ রাখায় ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্ট মেনশন করে অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, ‘৯০ দিনের শুল্ক স্থগিত করতে আমরা যে অনুরোধ করেছিলাম, তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়ায় প্রেসিডেন্ট আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার বাণিজ্য এজেন্ডাকে সমর্থন জানাতে আমরা আপনার প্রশাসনের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবো।’ 

চীন থেকে রপ্তানি সরবে: ওদিকে অন্যান্য দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আপাতত স্থগিত করলেও চীনের প্রায় সব পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ করেন ডনাল্ড ট্রাম্প। আগের দিন চীনের পণ্যে শুল্ক ১২৫ শতাংশ করার কথা বললেও বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস জানায়, এটা প্রায় সব পণ্যে হবে ১৪৫ শতাংশ। দেশটির ওপর এই শুল্ক ইতিমধ্যে কার্যকরও হয়েছে। 

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিকারকরা মনে করেছেন, এই শুল্ক শেষ পর্যন্ত বহাল থাকলে চীন থেকে মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সরবে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ১২৫ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কেননা, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো পণ্যের দাম আগের চেয়ে দ্বিগুণ। ফলে চীন থেকে রপ্তানি এখন আর লাভজনক হবে না। ভিয়েতনামে আগেই চীনা উদ্যোক্তারা বড় বিনিয়োগ করে ফেলেছেন। সেখানে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ কম। ফলে চীনের  বিনিয়োগ টানার সুযোগ বাংলাদেশের সামনে। 

তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র হিসাবে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখন থেকে ২ ডলারের একটি কটন টি-শার্ট চীন থেকে আমদানি হলে মোট শুল্ক দিতে হবে ২.৮৩ ডলার। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ থেকে একই টি-শার্ট রপ্তানি হলে শুল্ক দিতে হবে ০.৫৩ ডলার।

বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, উচ্চ শুল্কের কারণে চীনের ক্রয়াদেশ সরবে। কারখানাও স্থানান্তরিত হবে। চীনের হারানো ব্যবসা নিতে বাংলাদেশকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। 

পুরস্কৃত করবেন ট্রাম্প: বিশ্বের অনেক দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সমঝোতার চেষ্টা করেছে গত কয়েকদিনে। হোয়াইট হাউসের তরফে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যেসব দেশ প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করেনি তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। হোয়াইট হাউস বাণিজ্যিক অংশীদারদের প্রতি একটি কঠোর বার্তা পাঠিয়ে বলেছে, প্রতিশোধ নিতে যাবেন না, তাহলে আপনাকেও পুরস্কৃত করা হবে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পরিপালন করতে হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কার নির্ধারিত এ সময়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে। যাতে মার্কিন প্রশাসন বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ককে শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে রাজি হয়। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে। আলাদা যোগাযোগ করতে হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে। তিনিও মনে করেন, চীনা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ আসারও অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি: গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। এ হার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারলেওটেক্সার তথ্য বলছে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসে প্রধান রপ্তানিকারক দেশ চীনের রপ্তানি বেড়েছে ৯ শতাংশেরও কম। ভিয়েতনামের বেড়েছে ১১ শতাংশ। ভারতের বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। পাকিস্তানের পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ হারে। তবে রপ্তানি আয়ের অঙ্কে চীন ও ভিয়েতনামের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। চীনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৭৭ কোটি ডলার। ভিয়েতনামের ২৬৩ কোটি ডলারের মতো। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১৫০ কোটি ডলার। ভারত ও পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯৬ কোটি ডলার ও ৩৬ কোটি ডলার। গত কয়েক মাসের রপ্তানি প্রবণতা বলছে, চীন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে রপ্তানি পরিমাণের ব্যবধান কমছে। এই পরিসংখ্যান ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রপ্তানিকারকরা।

উল্লেখ্য, গত ২রা এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে প্রায় ৬০টি দেশের পণ্যে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশসহ বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এটি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল ৯ই এপ্রিল। ডনাল্ড ট্রাম্প কার্যকরের দিনে তিন মাসের জন্য দেশভিত্তিক বাড়তি শুল্ক আরোপ স্থগিত করেন। তবে ২রা এপ্রিলের ঘোষণায় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব পণ্যের ওপর সব দেশের জন্য ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়, যা ৫ই এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়ে গেছে।

পাঠকের মতামত

আমাদের থিংকট্যান্করা প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা দেশের জন্য আরও বিপদ ডেকে আনে।এদের থেকে আমাদের দুরে থাকা উচিৎ।

তৌফিকুর রেজা
১২ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ৯:৪২ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status