বাংলারজমিন
অল্প টাকায় ইতালি নেয়ার প্রলোভন
মাফিয়াদের ভয়াবহ নির্যাতনের পর নিখোঁজ মাদারীপুরের ৩ যুবক
মাদারীপুর প্রতিনিধি
২৬ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার
অল্প টাকায় লিবিয়া দিয়ে ইতালি নেয়ার প্রলোভন। এরপর লিবিয়ার বন্দি শিবিরে আটকে রেখে ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে হাওয়া বেগম ও বাবুল মাতুব্বর নামে দুই দালালের বিরুদ্ধে। মাফিয়াদের ভয়াবহ নির্যাতনের পর নিখোঁজ মাদারীপুর সদর উপজেলার হাউসদী গ্রামের ৩ যুবক। এই ঘটনায় আদালতে মামলা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে দালালচক্র। উল্টো ভুক্তভোগীদের মিথ্যা মামলার হুমকি দিচ্ছে দালালরা। তবে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে। এই ঘটনায় লিবিয়ায় অবস্থানরত এক দালালের হুমকির অডিও রেকর্ডে এসেছে এই প্রতিবেদকের হাতে। মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য হাউসদী এলাকার বাবুল ফকিরের ছেলে মারুফ হোসেন এবং তার ভাগনে মহিউদ্দিন মোড়ল লিবিয়ায় অবস্থানরত দালালের কাছে বন্দি। লিবিয়ার অবস্থারত এক দালাল বাবুল ফকিরকে হুমকি দিচ্ছে। তার হুমকির অডিও রেকর্ড নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো বাবুল ফকির (লিবিয়ায় বন্দি মারুফের পিতা): ভাই ভাই আমি গরিব মানুষ। টাকা জোগার করার সময় দেন। অপর প্রান্ত থেকে দালালের হুমকি, তোরে তো এক ঘণ্টা সময় দিয়েছি। এরপর প্রকাশ গালাগালি করে দালাল। এরপর ভুক্তভোগী করুন কণ্ঠে বলেন, একটু দয়া করেন ভাই, একটু দয়া করেন। মোটরসাইকেল বেইচ্যা আপনারে এক লাখ টাকা দিতেছি। এতগুলো টাকা কোথা থেকে দিমু?
দালাল: এর আগে তিনদিন দিছি সময়। ওগো যে ছাড়াই আনছি ওগো তো কম টাকা লাগতেছে। তোরা কি এহন জানোস বর্তমানে মাফিয়াগো হাতে গেলে কতো টাকা লাগে? ওগো তো কম টাকা লাগতেছে। এক এক জনের ২০ লাখ টাকা লাগে। এরপর ভুক্তভোগী মারুফের বাবা বলেন, দিমু তো। আপনারা আনছেন ছাড়াই দিমু আপনাগো টাকা। এরপর দালাল বলেন: তোগো একটা সুযোগ দিছি। আজকে এক লাখ দিবি, পরশু পাঁচ লাখ করে দুইজনে দশ লাখ দিবি। পরের দিন ক্লিয়ার করে দিবি। ভুক্তভোগীর বাবা: ঠিক আছে ভাই একটু আমারে সময় দেন। এরপর দালালের হুঙ্কার, টাকা দিতে যতক্ষণ লেট হইবে ততক্ষণ ওদের ওপর লাঠি চলবে। পরে ভিডিও কইর্যা পাঠাই দেবোনে।
ভুক্তভোগী মারুফের বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন: ভাই এমন কইরেন না, ভাই দয়া করেন। এরপর দালাল আদেশ দেয়, টাকা দিয়া ফোন দিবি, একেবারে সন্ধ্যার আজানের পর। এরপর ফোন কেটে দেয়। এভাবেই লিবিয়ায় বন্দিদের আটকে রেখে স্বজনের কাছে হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে।
সরজমিন জানা গেছে, মাদারীপুরে সদর উপজেলার মধ্য হাউসদী গ্রামের মারুফ হোসেন, মহিউদ্দিন মোড়ল, সোলায়মান আকন। উভয়ের বয়স ২০। বাড়িতে থাকতে দালালচক্র ওদের প্রলোভন দেখায় ইতালির মোটা বেতনের। এরপর লিবিয়া নিয়ে আটকে রেখে চালায় নির্যাতন। নির্যাতনের সময় স্বজনদের মোবাইলে শোনানো হয় নির্যাতনের বর্ণনা। টাকার জন্য লিবিয়ায় অবস্থানরত দালালরা মোবাইল ফোনে দেয় হুমকি। এরপর আদায় করা হয় টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালরা কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে মানবপাচার করে থাকে। প্রথম ধাপের দালালরা গ্রামাঞ্চলের সহজ-সরল মানুষদের অল্প টাকা ইতালি নেয়ার প্রলোভন দেখায়। এরপর তাদের ফাঁদের পা দিলেই তারা ভুক্তভোগীদের লিবিয়াতে অবস্থানরত মাফিয়াদের হাতে তুলে দেয়। এরপর বন্দি শিবিরে আটকে রেখে নির্যাতন করে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এই নির্যাতনে অনেকেই প্রাণ হারায়। এই চক্রের সঙ্গে স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যান, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক কর্মকর্তরাও জড়িত। স্বজনরা জানান, দালালে প্রলোভনে ছয় মাস আগে ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়ে মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য হাউসদী গ্রামের মারুফ হোসেন, মহিউদ্দিন মোড়ল ও সোলায়মান আকন। প্রথম কিছুদিন তাদের সঙ্গে স্বজনদের যোগাযোগ থাকলেও এখন যোগাযোগ নেই। লিবিয়ায় নেয়ার পরে তাদের অমানুষিক নির্যাতন করে। ভিটেমাটি বিক্রি করার পাশাপাশি চড়াসুদে টাকা এনে দালালদের হাতে তুলে দেয় স্বজনরা। দালালরা লাখ লাখ টাকা আদায়ের পর দীর্ঘদিন ধরেই নেই যোগাযোগ। বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তাও জানে না স্বজনরা। এই ঘটনায় স্থানীয় দালাল হাওয়া বেগম ও বাবুল মাতুব্বরের নামে ভুক্তভোগী পরিবার একাধিক মামলা করেছে। এরপরও মিলেনি সন্ধান। গ্রেপ্তার হয়নি দালালচক্র। উল্টো আরও হুমকি দিচ্ছে।
নিখোঁজ সোলায়মান আকনের মা সালমা আক্তার বলেন, ছেলেকে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন করে দফায় দফায় মুক্তিপণের জন্য টাকা আদায় করে। কয়েক দফায় বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে মোট ৩৫ লাখ ৪০ হাজার দেয়া হয়েছে। এরপরও ছেলের সন্ধান পাইনি। উল্টো আমাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার হুমকি দিচ্ছে স্থানীয় দালাল হাওয়া বেগম এবং বাবুল মাতুব্বর। নিখোঁজ মারুফের বাবা এবং অপর নিখোঁজ মহিউদ্দিন মোড়লের মামা বাবুল ফকির বলেন, স্থানীয় দালাল হাওয়া বেগম এবং বাবুল মাতুব্বর আমাদের সহজে ইতালি নেয়ার প্রলোভন দেখায়। এরপর লিবিয়াতে নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করে। আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছে ওই দালালচক্র। এরপরও তাদের সন্ধান পাইনি। এ ঘটনায় অভিযুক্ত হাওয়া বেগম ও বাবুল মাতুব্বরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বাড়িতে গেলে তাদের পাওয়া যায়নি। বাবুল মাদারীপুর শহরের চরমুগরিয়া বন্দর শাখা সোনালী ব্যাংকে দীর্ঘদিন থেকে কর্মরত। তবে মামলা পরে অনুপস্থিত রয়েছেন সেখানেও। এ ব্যাপারে মাদারীপুর সদর থানার ওসি আদিল হোসেন জানান, দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। হুমকি দিয়ে থাকলে সেটাও গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হবে। মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হাছান বলেন, মানবপাচারের বিষয় তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।