বিশ্বজমিন
সংবাদমাধ্যমে হামলা: ইরানে কি যুদ্ধাপরাধ করেছে ইসরাইল?
ইয়ানিভ কুবোভিচ ও চেন মানিত
(২ দিন আগে) ২৯ জুন ২০২৫, রবিবার, ৯:৪৫ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৪:৪০ অপরাহ্ন

ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ ছিল গত কয়েক দশকে ইসরাইলের যেকোনো সামরিক অভিযানের চেয়ে ভিন্ন। এই ভিন্নতা কেবল দূরপাল্লার হামলা বা বেসামরিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতির কারণেই নয়, বরং এটি ছিল এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ- যার পরিষ্কার সীমান্ত, একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে স্বচ্ছ পার্থক্য রয়েছে। একজন আইনি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক হারেৎজ পত্রিকাকে বলেন, যে জটিল আইনগত প্রশ্নগুলো গাজা ও লেবাননে ছিল, তা ইরানের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সহজ। কারণ আমরা যে সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা করেছি, তা জনবসতির বাইরে অবস্থিত এবং সেখানে সাধারণ বেসামরিক মানুষ থাকেন না।
তবে বাস্তবতার মুখে এই সরলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে যখন তেহরানে ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। তেল-আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এলিয়াভ লিবলিখ বলেন, কোনো সম্প্রচার মাধ্যম- যদি সেটি প্রপাগান্ডা প্রচার করেও তবু স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈধ সামরিক লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে না। ইসরাইলেও তো এমন অনেক মিডিয়া আছে যারা প্রপাগান্ডা বা উস্কানিমূলক বার্তা দেয়। তিনি আরও বলেন, ইসরাইল দাবি করেছে যে সামরিক উদ্দেশ্য নিয়ে ইরানে মিডিয়া সেন্টারে হামলা হচ্ছিল। কিন্তু প্রতিরক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও আইডিএফ মুখপাত্র সবাই বলেছেন, কারণ ছিল এসব মিডিয়ার প্রচার কার্যক্রম। তাই এই হামলার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ তামার মেগিদ্দো বলেন, একটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে হামলা তখনই বৈধ হতে পারে, যদি সেটি সরাসরি ও কার্যকরভাবে সামরিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়, এবং বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি সামরিক সুবিধার তুলনায় অতিরিক্ত না হয়।
ইসরাইল বহু বছর ধরে দাবি করে আসছে যে, গাজা বা লেবাননে তারা উগ্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়ছে, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের হাসপাতালে, স্কুলে বা জনবসতির মাঝে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু ইরানের মতো একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে আইন অনেক স্পষ্ট, বলে জানিয়েছেন ইসরাইলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তবে বাস্তবে ‘গ্রে জোন’ রয়ে গেছে। যেমন: ইসরাইলের অনেক সামরিক ঘাঁটি। যেমন- কিরিয়া (তেল আবিব), তেল হাশোমার (রামাত গান) শহরের মাঝেই অবস্থিত- যা ইরানের বৈধ লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। আইডিএফ সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে যুক্ত কয়েকজন প্রকৌশলীকে লক্ষ্য করেছে। কিন্তু অধ্যাপক লিবলিখ বলেন, যুদ্ধের আইনে কেবলমাত্র সেনাবাহিনীর সদস্যদের বা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের উপর হামলা বৈধ। শুধু অস্ত্র উন্নয়নের কাজ করলেই কেউ বৈধ লক্ষ্য হয়ে ওঠে না। এ ধরনের হামলা আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত এবং ইসরাইলের নিজস্ব বিজ্ঞানী ও একাডেমিকদেরও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন।
ইসরাইল ও ইরান কেউই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য নয়। তবে সার্বভৌম বিচারধারা অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠলে অন্য দেশগুলোও ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও জোটগত হামলার ফলে ইসরাইল আপাতত জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত রয়েছে। এর মধ্যেই যুদ্ধ শুরুর পঞ্চম দিনে ইসরাইল জাতিসংঘে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলেছে- এই অভিযান আসলে হামাস ও হিজবুল্লাহর মাধ্যমে ইরানের সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের অংশ, এবং এটি ছিল পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিরোধে একটি জরুরি পদক্ষেপ, নতুন কোনো যুদ্ধ নয়। অধ্যাপক লিবলিখ বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে একটি দেশ কেবলমাত্র তখন আত্মরক্ষামূলক হামলা চালাতে পারে, যখন তাৎক্ষণিকভাবে একটি সশস্ত্র আক্রমণের সম্মুখীন হয় বা নিশ্চিতভাবে তা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু যদি কোনো দেশ ভবিষ্যতে অস্ত্র বানাতে পারে- এই শঙ্কায় আগাম হামলা চালানো হয়, তাকে প্রতিরোধমূলক আত্মরক্ষা বলা হয়, যা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তামার মেগিদ্দো বলেন, বেসামরিক অবকাঠামো যেমন বিদ্যুৎ, পানি, হাসপাতাল বা বন্দর লক্ষ্যবস্তু করলে তা সরাসরি যুদ্ধাপরাধ। তবে যদি এগুলো যুদ্ধ চলাকালীন সেনাবাহিনীকে পরিষেবা দেয়, তখন সেগুলোর সুরক্ষা কমে যায়। যেমন: ইরানের সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে হামলা করা হয়েছে- যা সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা তা প্রমাণ না করলে তা আইনবিরুদ্ধ।
ইরানের হাসপাতালে হামলার খবর এলেও তা সত্য ও উদ্দেশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ইরানের এক ব্যালিস্টিক মিসাইল ইসরাইলের সোরোকা মেডিকেল সেন্টারে আঘাত হানে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক লিবলিখ বলেন, যদি এক পক্ষ যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে, তবু অন্য পক্ষকে সেই নিয়ম মানতেই হবে। প্রতিশোধ হিসেবে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা বৈধ নয়। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেন, শিগগিরই তেহরানের বাসিন্দারা মূল্য দেবে। পরে তিনি এক্সে লিখেছেন, তেহরানের বাসিন্দাদের উপর সরাসরি হামলার পরিকল্পনা নেই, তবে যারা শাসনব্যবস্থার অংশ, তাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হবে।
অধ্যাপক লিবলিখ বলেন, এ ধরনের বিবৃতি গাজা যুদ্ধেও ইসরাইলের জন্য আইনি বিপদের কারণ হয়েছে, এবং একই রকম ঝুঁকি তৈরি করছে।
(হারেৎস পত্রিকা থেকে অনুবাদ)