বিশ্বজমিন
জাপানে যেমন করে ফাঁসি কার্যকর হয়
মানবজমিন ডেস্ক
(১৭ ঘন্টা আগে) ৩০ জুন ২০২৫, সোমবার, ২:৫৪ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৩ পূর্বাহ্ন

টোকিওর কাটসুশিকা সিটিতে অবস্থিত টোকিও ডিটেনশন হাউস বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ এক সরকারি দালান। কিন্তু এর ধূসর দেয়ালের আড়ালে লুকানো রয়েছে এক ভীতিকর বাস্তবতা। এখানেই জাপানের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এক ঠাণ্ডা, কাঠের প্যানেলে ঘেরা কক্ষে। সেখানে তাদের পরিষ্কার আলোতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ খবর দিয়েছে অনলাইন ডেইলি মেইল।
জাপানে মৃত্যুদণ্ডের প্রক্রিয়াটি রুদ্ধশ্বাস। জি-৭ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া একমাত্র দেশ হিসেবে এখনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর রেখেছে জাপান। ফাঁসির আগে সেখানে দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদেরকে হাঁটিয়ে নেয়া হয় একটি ছোট স্বর্ণমূর্তির পাশে। এই মূর্তিটি কাননের। কানন হলো বৌদ্ধ এক করুণার দেবতা। তারপর তারা দাঁড়ান একটি লাল বর্গাকার চিহ্নের উপর। এটা আসলে ফাঁসির ফাঁদ। নীল পর্দা সরিয়ে দেওয়া হয়, আর কাচের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা গ্যালারি থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা দেখতে পান পুরো প্রক্রিয়াটি।
এরপর বন্দির চোখ-মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। গলায় ফাঁসির রশি পরিয়ে দেওয়া হয়। একজন কর্মকর্তা লিভার টেনে ফাঁদটি খুলে দেন। বন্দি নিচে পড়ে যান, মৃত্যু হয় পতনের ধাক্কায়।
জাপানে মৃত্যুদণ্ডের সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো এর হঠাৎ বাস্তবায়ন। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন বন্দিদের মাসখানেক আগে থেকেই মৃত্যুর তারিখ জানানো হয়, জাপানে অনেক সময় মাত্র এক ঘণ্টা আগে জানানো হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে।
জাতিসংঘের কমিটি এগেইনস্ট টর্চার জানিয়েছে, ফাঁসি হবে এটা আগে জানতে পারেন বন্দি। কিন্তু কবে কখন হবে তা নিয়ে থাকে অনিশ্চয়তা। ফলে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন বন্দি ও তার পরিবার। সম্প্রতি ‘হ্যাংগিং প্রো’ নামে পরিচিত কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার তাকাহিরো শিরাইশির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর এই নিষ্ঠুর পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়।
২০১৭ সালে নয়জনকে হত্যা করে শিরাইশি। তার টোকিওর অ্যাপার্টমেন্টে কোল্ড স্টোরেজে পাওয়া যায় আটজন নারী ও কিশোরীর এবং একজন পুরুষের দেহাবশেষ। তিনি আত্মহত্যাপ্রবণ মেয়েদের টুইটারের মাধ্যমে টার্গেট করতেন। তার অ্যাকাউন্টে একটি আঁকা কার্টুন ছিল, যেখানে এক ব্যক্তি গলায় দড়ি ঝুলিয়ে রেখেছে, হাত ও গলায় দাগ। তার বায়োতে লেখা ছিল- ‘আমি কষ্টে থাকা মানুষদের সাহায্য করতে চাই। দয়া করে আমাকে ডিএম করুন।’
কিন্তু বাস্তবে, এই সহানুভূতির মুখোশের আড়ালে তিনি ছিলেন ভয়ঙ্কর হিংস্র। তিনি ৩ কিশোরীসহ মোট ৮ নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করেন। একজন পুরুষকে হত্যা করেন যিনি নিহত নারীদের একজনের প্রেমিক ছিলেন। দেশটির আইনমন্ত্রী কেইসুকে সুজুকি এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানান, এই ঘটনা সমাজে প্রবল আতঙ্ক ও অনিরাপত্তা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, তিনি মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সই করেছেন, তবে ফাঁসি প্রত্যক্ষ করেননি।
ফাঁসির প্রক্রিয়াটি কেমন?
সাবেক কারা কর্মকর্তা ও আইনজীবী ইয়োশিকুনি নোগুচি ২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ফাঁসির দিন সকালে বন্দিকে জানানো হয় যে আজই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। তারপর তাকে একটি বিশেষ কক্ষে নেওয়া হয় এবং সেখানে সবসময় নিরাপত্তারক্ষীরা থাকেন, যাতে বন্দি পালাতে বা আত্মহত্যা করতে না পারেন। ফাঁসির আদেশ দেয়ার পর পুরো প্রক্রিয়াটি মাত্র কয়েক মিনিটে শেষ হয়। বন্দিকে চোখ বেঁধে, গলায় দড়ি পরিয়ে লিভার টেনে দেওয়া হয়। নিচে ধূসর টাইলস দেওয়া এক কক্ষে তার দেহ ঝুলে থাকে। তারপর একজন ডাক্তার এসে মৃত্যু নিশ্চিত করেন, দেহ পরিষ্কার করে মর্গে পাঠানো হয়। নোগুচি জানান, মাত্র একটি মাথা নাড়ানো এবং একটি লিভার টানার মাধ্যমে একজন মানুষের জীবন শেষ হয়ে যেতে দেখে তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন।
আরও মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা: ইয়ুকি এন্ডো
২০২১ সালে ইয়ুকি এন্ডো নামের ১৯ বছর বয়সী এক যুবক প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তার পছন্দের মেয়েটির বাবা-মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তার ছোট বোনকেও চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। আদালত তাকে সম্পূর্ণরূপে দায়ী বলে ঘোষণা দেয় এবং কোনো অনুতাপ না থাকায় মৃত্যুদণ্ড দেয়। এন্ডো হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৮-১৯ বছর বয়সে সংঘটিত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড পান। কারণ ২০২২ সালে জাপান প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধের বয়সসীমা ২০ থেকে ১৮-তে নামিয়ে আনে।
জাপানের আইনমন্ত্রী সুজুকি বলেন, আমি মনে করি মৃত্যুদণ্ড তুলে দেয়া উপযুক্ত নয়। সমাজে গুরুতর অপরাধ বাড়ছে, আর জনগণের বিশাল অংশ এখনো মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে। তবে, তিনি স্বীকার করেন যে বিরোধিতাও ধীরে ধীরে বাড়ছে।
অতীতের নৃশংসতা: আকিহাবারা হত্যাকাণ্ড
২০০৮ সালে টোমোহিরো কাতো একটি ট্রাক চালিয়ে জনতার ভিড়ে ঢুকে পড়ে। পরে ছুরি দিয়ে আরও মানুষকে আক্রমণ করে। ৭ জন নিহত হয়, ৮ জন আহত। অনলাইনে অপমান আর মানসিক ভাঙনের কারণে কাতো এই ঘটনা ঘটায়। ২০১১ সালে সে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়, কিন্তু তা কার্যকর হতে ১১ বছর সময় লাগে।