অর্থ-বাণিজ্য
অসাধু আমদানিকারকদের দৌরাত্মে হুমকির মুখে দেশিয় শিল্প: সেমিনারে বক্তারা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
(৭ ঘন্টা আগে) ৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৮:০৬ অপরাহ্ন

অসাধু আমদানিকারকদের দৌরাত্মে চরম হুমকির মুখে দেশিয় শিল্প। এ দৌরাত্মে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে কসমেটিকস ও স্কিনকেয়ার খাত। আর এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে। মানসম্মত পণ্য নিশিচত করতে দেশিয় শিল্পের সুরক্ষায় কঠোর নজরদারি বাড়ানো সহ অশুভ দাপট বন্ধ জরুরি।
বৃহস্পতিবার কাওরানবাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সম্মেলন কক্ষে এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। এসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশ (এএসবিএমইবি) আয়োজিত ‘কসমেটিকস ও স্কিনকেয়ার শিল্পখাতের রপ্তানি সম্ভাবনা: ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য আর নয়’ শীর্ষক এ সেমিনার আয়োজন করে।
সেমিনারের প্রধান অতিথি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলিম আখতার খান হুঁশিয়ারি দেন, ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় কোনভাবে পিছপা হবে না ভোক্তা অধিদপ্তর। ভোক্তা যেন প্রতারিত না হন, এ বিষয়ে সব পক্ষকেই ভূমিকার রাখার আহবান জানান তিনি। ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্যকে বিষফোঁড়া উল্লেখ করে ভোক্তা মহাপরিচালক বলেন, সমন্বিতভাবেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে দেশে উৎপাদিত মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহারের আহবানও জানান তিনি।
এফবিসিসিআই-এর সাবেক পরিচালক ইসহাকুল হোসেন সুইট বলেন, দেশীয় উৎপাদনে সক্ষমতা তৈরি হওয়ার পরও অসৎ উপায়ে আমদানি বন্ধ করতে না পারলে দেশে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ সুরক্ষা, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ ও দেশীয় উৎপাদনশীলতায় স্থবিরতা তৈরি হতে পারে। এতে পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত না হয়ে বরং পুরোপুরি আমদানির নামে অসাধু চক্রের কবলে পড়তে পারে দেশ। দেশে ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিতে নিয়ম-নীতি সহজ করারও আহবান জানান তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ-আইবিএফবির সহসভাপতি এমএস সিদ্দিকী বলেন, দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় এখনই নজর দিতে হবে। সরকার অসাধু দাপট বন্ধ করতে না পারলে দেশীয় শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আর তাতে করে লক্ষাধিক লোক বেকার হয়ে রাস্তায় নামবে। যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করবে। দুষ্ট চক্রে প্রভাবিত হলে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। ফলে সরকারকে এর জন্য বড় মাশুল গুনতে হবে।
এসএমই ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি আলি জামান বলেন, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কোন কোন মহলের ভূমিকা রহস্যজনক এবং দেশীয় শিল্প বিরোধী। এ কারণে স্থানীয় বিনিয়োগ প্রবল অসম প্রতিযোগিতা ও ঝুঁকির মুখোমুখি হয়ে পড়ছে। তার মতে, কোন কোন মহলের শিল্পায়ন বিরোধী মনোভাব কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বর্তমান সরকারের যে অগ্রাধিকার নীতি রয়েছে তার পরিপন্থী। বর্তমানে দেশে কসমেটিকস শিল্পের যে প্রসার ঘটছে তাতে আমদানির লাগাম টেনে ধরার এখনই সময়।
চিত্রনায়ক মামনুন হাসান ইমন, এনবিআরের তথ্য তুলে ধরে বলেন, শুধুমাত্র কালার কসমেটিকস খাতে চলতি বছরে আমদানি প্রায় ৫শ কোটি টাকার। আন্ডার ইনভয়েস এবং ওজনে ফাঁকি না দিলে প্রকৃতপক্ষে টাকার অঙ্কে এটি হওয়ার কথা ন্যূনতম ১৬শ কোটি টাকা। সে হিসেবে শুধুমাত্র আমদানিতেই ফাঁকি হচ্ছে প্রায় ১১শ কোটি টাকা। এছাড়া অসাধুরা নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধ করছেন না। গেল অর্থবছরে এ খাতের আমদানিতে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স পেয়ে মাত্র ১৭ কোটি টাকা। বিপরীতে দেশিয় শিল্পের শুধুমাত্র ১টি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে একশ’ কোটি টাকার বেশি।
ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক ফকির মোহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন বলেন, দেশের কসমেটিকস ও স্কিনকেয়ারের যে মার্কেট ছিল সে আকার এখন অনেক বড়। তিনি জানান, বাজারে অভিযান পরিচালনা করার সময় দেখতে পান, আইন না মানার হিড়িক। বিশেষ করে আমদানিকৃত বিউটি ও স্কিনকেয়ার পণ্য নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই বলেও জানান মুনাওয়ার হোসেন।
ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শারমিনা হক জানান, বর্তমানে কতিপয় মানহীন ও ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ির খবর প্রায়শই দেখা যায়। এসব ভেজাল পণ্য ব্যবহার করে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। পড়ে যাচ্ছেন বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এজন্য স্থানীয় উৎপাদনকে নীতি সহায়তা দিয়ে মানসম্মত পণ্য ক্রেতাদের জন্য সুলভ করা জরুরি। দেশে গ্লোবাল ব্র্যান্ডের উৎপাদন কার্যক্রম সম্প্রচারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি সহজলভ্য করা গেলে এবং সরাসরি কসমেটিকস পণ্যের আমদানি শুল্কহার বাড়ানো হলে দেশীয় উৎপাদন ও উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়া সহজ হবে।
এএসবিএমইবি-এর সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন বলেন, কসমেটিকস খাতে এখনই লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। শুধুমাত্র সরকারের নীতি সহায়তার অভাবে শিল্পের আকার ও ব্যাপকতা আটকে আছে। আমদানি বিকল্প দেশিয় শিল্পের বিকাশ ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। কর্মসংস্থান ছাড়াও উপরন্তু, রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। এজন্য নীতিনির্ধারণে অগ্রাধিকার তালিকায় শীর্ষে থাকা উচিত স্থানীয় বিনিয়োগ সুরক্ষা। এছাড়া কসমেটিকস আমদানি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ শুল্ক, কর ও ভ্যাট ফাঁকির যে অভিযোগ উঠেছে তা দুদকের দ্বারা তদন্তের দাবি জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরো বলেন, রাতারাতি মোটা অংকের টাকা হাতানোর জন্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, আন্ডার ইনভয়েসিং, শুল্ক ফাঁকি, বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ মানহীন পণ্য ঠেকাতে এবং বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে কসমেটিকস পণ্যের ওপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে নতুন শুল্ক নীতি করেছে তা প্রতিরোধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে অসাধু আমদানীকারকরা। এ অসাধু আমদানিকারকদের দৌরাত্মের কারণেই দেশের কসমেটিকস শিল্প গড়ে উঠেনি।